বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
ঢাকা: বর্তমানে খেলাপি ঋণের যে পরিমাণ তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের। তবে একটি বিদেশি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৯৮ শতাংশ। আবার স্থানীয় একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ। আর চতুর্থ প্রজন্মে একটি বেসরকারি ব্যাংক, যার নাম কেলেঙ্কারি কারণে পরিবর্তন করা হয়েছে তার খেলাপির পরিমাণ ৬৭ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি আরও দুটি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ২৭ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ শতাংমের ওপরে রয়েছে।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ যাবৎকালে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। অনেকগুলো ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ আদায় করতে পারছে না, আবার তা খেলাপি হিসেবেও চিহ্নিত করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও এতে নজর দিচ্ছে না। এতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্যও বেরিয়ে আসছে না। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া উচ্চ আদালতে রিট করে অনেক ঋণ নিয়মিত করে রাখা হয়েছে। ফলে আসলে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত জুলাইয়ে পর খেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা হালনাগাদ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউনপেমেন্টের অর্থ জমা দিতে হতো। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেয়া হতো। এছাড়া নীতিমালায় খেলাপি হলেও নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথাও বলা হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। গত এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বা ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (বিডিবিএল) সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৪৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ।
বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের আধিক্য বেশি। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ খাতের অন্য ব্যাংক প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ ঋণ। এছাড়া বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ দশমিক ৯০ শতাংশই খেলাপি। এছাড়া বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে খেলাপিতে শীর্ষে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৮৩ শতাংশের বেশি খেলাপি।
আর চতুর্থ প্রজন্মে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণ করা ৫ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকাই খেলাপি।
এ ব্যাপারে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায় করার জন্য আমরা মনিটরিং টিম চালু করেছি। খেলাপি ঋণ আদায়ে সব ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই খেলাপি ঋণ আদায়ে আমাদের প্রতিফলন হবে। ধাপে ধাপে কিভাবে খেলাপি ঋণ কমানো যায় সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি’। তিনি আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে একটি এমওইউ চুক্তি হয়েছে। তিনি নির্দেশনা দিয়েছন কিভাবে খেলাপি ঋণ কমানো যায়। আমরা সেইভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি শীঘ্রই আমাদের খেলাপি ঋণ কমে যাবে’।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৫৩ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৪৪১ কোটি বা ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এ ব্যাপারে সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারই খেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখছে। তাহলে খেলাপি কমবে কিভাবে। খেলাপি কমাতে হলে সরকারে সদিচ্ছা থাকতে হবে। তছাড়া খেলাপি কমানোর কোন পথ নেই। ব্যাংকগুলো ঘুরে ফিরে খেলাপি ব্যক্তিকেই ঋণ দিচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কঠোরভাবে খেলাপি ঋণ আদায় করার জন্য উদ্যোগী হওয়া’।