করাচি: পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে সশস্ত্র জঙ্গি হামলা হয়েছে। পর পর তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল বন্দর এলাকা। গোয়াদর বন্দরটি বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত, যা রাজনৈতিক ভাবে বরাবরই উত্তপ্ত। পাক সরকার বিরোধী বিচ্ছিন্নতাকামীদের ঘাঁটি হিসেবেও ধরা হয় বালুচিস্তানকে। পাকিস্তান সরকারের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র বেলুচিস্তানের পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছেন ওই বিচ্ছিন্নতাকামীরা।
বুধবার পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর কর্তৃপক্ষের কমপ্লেক্সের ভিতর একদল সশস্ত্র জঙ্গি ঢোকার চেষ্টা করে বলে জানা গিয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, সেখানে তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে জঙ্গিরা। পর পর বিস্ফোরণ ঘটে। মাকরানের কমিশনার সইদ আহমেদ উমরানি জানিয়েছেন, জঙ্গি হামলার খবর পেতেই ওই কমপ্লেক্স ঘিরে ফেলে পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনী। দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়।
গোয়াদরের সিনিয়র সুপারিটেন্ডেন্ট জোহেব মহসিন জানিয়েছেন, পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনীদের গুলিতে ৮ জঙ্গি মারা গিয়েছে। United Nations Department for Safety And Security জানিয়েছে, পর পর বিস্ফোরণ ঘটে। তার পর শুরু হয় গুলিবর্ষণ। বন্দরের ওই জায়গায় সরকারি দফতর এবং আধা সেনাবাহিনীর দফতরও রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সাত জঙ্গির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও, জঙ্গি হামলায় হতাহতের সংখ্যা এখনও স্পষ্ট নয়।
এই হামলার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ সংগঠন বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি -র মজিদ ব্রিগেড। গত এক বছর ধরেই পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে নাশকতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে পাক সরকারের সঙ্গে তেহরিক-ই-তালিবানের শান্তিচুক্তি ভেস্তে যায়, তার পর থেকেই একের পর এক হামলার ঘটনা। এর আগে, নভেম্বর মাসে গোয়াদরেই জঙ্গি হামলায় ১৪ পাকিস্তানি সৈনিকের মৃত্যু হয়।
পাক সরকারের একটি রিপোর্টে জানানো হয়, শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই ৯৭টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানে, তাতে সবমিলিয়ে ৮৭ জন মারা গিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১১ জন। বালুচিস্তানে হিংসা, নাশকতা আচমকা বেড়ে গিয়েছে বলেও উল্লেখ ছিল রিপোর্টে। এদিনের হামলার পর বালুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনীর প্রশংসা করেন। তিনি জানানস, হিংসার আশ্রয় নিলে সরকার কাউকে ক্ষমা করবে না। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম শরিফও এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন।
গোয়াদর বন্দরে হামলার দায় স্বীকার করেছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি -র যে মজিদ ব্রিগেড, ২০১১ সালে তার প্রতিষ্ঠা। গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী এই সংগঠনর নামকরণ হয় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর এক দেহরক্ষীর নামে, যিনি ভুট্টোকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যান। আফগানিস্তানে তো বটেই ভারতেও এই সংগঠনের শাখা ছড়িয়ে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। পাকিস্তান-ইরান সীমান্তেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে। এই মজিদ ব্রিগেড মূলত আত্মঘাতী হামলা চালায়। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে করাচি ইউনিভার্সিটির কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের বাইরে যে আত্মঘাতী হামলা হয়, তারও দায় স্বীকার করেছিল মজিদ ব্রিগেড। ২০২২ সালে বালুচিস্তানের নুশকি এবং পঞ্জগুর জেলাতেও হামলা চালায় তারা।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালের ১১ অগস্ট ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়েছিল দেশীয় রাজ্য কালাত। ১২ অগস্ট কালাতের শাসক মির সুলেমান দাউদ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতার মেয়াদ ছিল মাত্র সাত মাস। ১৯৪৮-এর ২৭ মার্চ পর্যন্ত। বেলুচিস্তানের মানুষের কাছে সেই দিনটা আজও যন্ত্রণার ‘পরাধীনতা দিবস’! সাত দশক আগে ওই দিনেই পাকিস্তানি সেনা দখল করেছিল বেলুচিস্তান। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তৎকালীন শাসককে বাধ্য করেছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে।
বেলুচিস্তানের পরবর্তী ইতিহাস ফের নতুন স্বাধীনতার যুদ্ধের। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর কয়েক হাজার মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার। ‘বেলুচিস্তানের গান্ধী’ বলে পরিচিত স্বাধীনতাপন্থী নেতা আবদুল কাদির বালোচ বছর কয়েক আগে দিল্লিতে বলেছিলেন, তাঁরা চান ১৯৭১-এ ভারত যে ভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে ভাবেই পাশে দাঁড়াক বেলুচিস্তানের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে বেলুচিস্তানের উপর পাক নিপীড়ন বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরব হওয়ার আবেদনও জানিয়েছিলেন তিনি।