খোন্দকার মহিতুল ইসলাম রঞ্জু
আরব্য উপন্যাসে পড়েছিলাম: এক রাজ্যে ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র আছে, কিন্তু মানবজীবনের যেন কোনো সাড়াশব্দ নাই। কোনো এক কারণে গোটা রাজ্য ঘুমপুরি। রাজবাড়ির বল্লভপুর গ্রামেও আমার সময়ে সময়ে এমনটি মনে হয়েছে। সব কিছু যেন শুনশান। অবশ্য এখন হাড় কাঁপানো শীত। আমাদের নিজেদের বাড়িটাও অনেকটা পতিত বাড়ি। এমন পতিত বাড়ি বেশকিছু চোখে পড়েছে। নানা কারণে কেউ কেউ গ্রামছাড়া। আবার কোনো জায়গায় ভাল ভাল ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। আমি আমার চাচাতো ভাইর কাছে জানতে চাইলাম: কেন এমন হয়েছে। ওর জবাব হলো: গ্রামের মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরমুখী। যেসব ছেলেরা কাজ নিয়ে বিদেশ গেছে, তারা টাকা পাঠানোর পর তাদের বাড়িঘরের উন্নতির জন্য সে টাকা লগ্নি হয়েছে।
গ্রামের বাড়িতেও হাই কমোড এবং টাইলস ফিটিং টয়লেট। মোটরে পানি উঠছে ট্যাংকে। কল টিপলে জল মিলছে। সদ্য ধনী হওয়া পরিবারের সদস্যদের চালচলন, হাবভাবে বাবুয়ানা এসেছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। শহুরে জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা চলে।
অপরদিকে গরীব লোকজন ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধা নিয়ে কর্ম সংস্থানে আত্মনিয়োগ করেছে। ফলে তাদের অহেতুক আড্ডা বা গুলতানি করে সময় কাটানোর অবকাশ নাই। সময়টাই এমন, প্রত্যেকে যে যার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত।
গ্রামের মাতব্বর সাহেবদের প্রভাব আগের মতো না থাকলেও এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আছে। ঠুনকো বিবাদ আছে ভাইয়ে ভাইয়ে, পরিবারে, প্রতিবেশীতে। জমির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিবাদ ও মামলা আছে। একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড করা নিয়ে বিবাদ। গ্রামে ধনীদের কাচারিঘরে বিচারআচারও হয়। তবে অতীতের মতো সবসময় একে অন্যের পেছনে লেগে খাকার সময় নাই।
দেশের জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন এলে চায়ের আড্ডায় তর্কবিতর্ক হয়। দলাদলিও আছে। সবচেয়ে বড়কথা, গ্রামে এখন দুটো ভাত বা সামান্য সাহায্যের জন্য স্বচ্ছল লোকের বাড়িতে গরীবরা আর ধর্ণা দেয় না। গরীবদের আত্মসম্মানবোধ বেড়েছে। এটা কোনোদিনই হতো না, যদি না গরীবরা ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা না পেতো। তারা তো টাকা কীভাবে গুণতে হয়, তাইই জানতো না। এখন ক্ষুদ্রঋণের বিপরীতে তারা বেশী হারে সূদ দিয়ে শোষিত হচ্ছে-এ মায়াকান্না যারা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা কেউ গরীবদের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়।
ধনীরা আফসোস করে: কি যে দিনকাল পড়লো। কাজের জন্য লোক ডেকে পাওয়া যায় না। দিনমজুরদের (স্থানীয় ভাষায় বলে ‘পইরেদ’) মজুরি বেড়েছে। কেউ বেগার খাটে না। আগে পায়ে হেঁটে গ্রামের মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতো। এখন ভ্যান বা বিদ্যুৎচালিত অটোতে চলাচল করে। ভ্যানও চলে ব্যাটারিতে।
অতীতে ধনীদের জন্য পাল্কি ছিল। বেহারা ছিল। দূর অতীতে ছিল ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি। সেসব পাট অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এখনও ঘোড়ার গাড়িতে মাল বহনের চল আছে।
এখন শহর থেকে ধনীরা সরাসরি গাড়ি নিয়ে বাড়ি আসে। কমবেশী প্রায় প্রতি বাড়িতে মোটরসাইকেল আছে। সাইকেলতো ডালভাত। প্রায় প্রতি বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। গ্রামেগঞ্জে ভ্যান ও অটো চলে। ভ্যানচালকেরও দৈনিক রোজগার আছে চার থেকে পাঁচশ টাকা। তাই চাল ডাল পিঁয়াজের দাম বাড়লে তারা অসন্তুষ্ট হয় বটে তবে কেনার ক্ষমতা হারায় না।
গ্রামে মাসে ছয়শ টাকার বিনিময়ে ওয়া্ইফাই সংযোগ পাওয়া যায়। ঘরে ঘরে রঙিন টিভি,ফ্রিজ। ডিস লাইনের সংযোগ পাওয়া যায়। তাতে গ্রামে বসে মানুষ ঢাকার চ্যানেলের বদলে প্রতিবেশী দেশের চ্যানেলগুলোর কূটচালের নাটক দেখে নেশায় মত্ত হয়ে। তারাও বলতে শিখে গেছে, ঢাকার চ্যানেলের মান ভাল না। তাদের নাকি টানে না। বিজ্ঞাপন বেশী দেখায়। তাতে তারা তিতি বিরক্ত। তাই টিভি মানে জি বাংলা, স্টার জলসা। টিভি নিউজ বা রেডিওতে বিবিসি বাংলা শোনার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই।
কোনো বাড়িতে এখন আর রেডিও সেট নাই। বাংলা সংবাদগত্র পড়ার আগ্রহ আছে কারো কারো। তবে ফ্রিতে। এজন্য বিকেলে পাশেই হরিণবাড়িয়া বাজারে কয়েকটি দোকানে সংবাদপত্রের পাতা নিয়ে একহাত থেকে আরেক হাত টানাটানি হতে দেখেছি।