সোমলতা গোস্বামী:
ইউরোপ বা আমেরিকা ভ্রমণ না হলেও চলতে পারে, কিন্তু ইজিপ্ট একবার যেতেই হবে। এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। সেই স্কুল লাইফ থেকেই ভেবে এসেছি একবার অন্তত মিশরে যাবই। সামনাসামনি দেখতেই হবে মিশরীয় সভ্যতাকে। অবশেষে গত ডিসেম্বর মাসে আমার স্বপ্নের সফর বাস্তবায়িত হল।
আমি বেড়াতে খুব ভালোবাসি। ইতিহাসও আমার খুব পছন্দের। আমি আমার ছেলে ঋত্বিককে নিয়ে মিশর ঘুরে এলাম। যাতায়াত মিলিয়ে এগারো দিনের জন্য স্বপ্নলোকে যাত্রা।
‘পরিচয়’ নামে একটি ট্যুর সংস্থার সঙ্গে গিয়েছিলাম আমরা। কলকাতা থেকে মুম্বাই হয়ে প্রথমে কুয়েত এয়ারলাইন্সে কুয়েত গেলাম। তারপর কুয়েত থেকে কায়রো।
কায়রো বিমানবন্দরে নেমেই প্রথমে হাতঘড়ি ও মুঠোফোনের সময়টা বদলে নিতে হলো। সময়ের হিসেবে মিশর ভারতের থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। বিমানবন্দরে আমাদের জন্য বাস অপেক্ষা করছিল। আমরা সোজা গেলাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ কায়রো ঈজিপশিয়ান মিউজিয়ামে। সেই ছোট্টবেলার ইতিহাস বইতে মিশর সম্পর্কে যা যা পড়েছি, সেগুলি সব চোখের সামনে দেখে-অসম্ভব রোমাঞ্চিত লাগছিল।তুতানখামনের মাস্ক, নারমার প্যালেট (প্রথম ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট), ফ্যারো গফুর স্ট্যাচু, ফ্যারো খাফরার স্ট্যাচু, আখেনাতেরের আবক্ষ মূর্তি, তুতানখামনের পিরামিড থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার ও কাসকেট। এ ছাড়া বহু মমি-এমনকী, পোষা কুকুর, কচ্ছপ ইত্যাদির মমিও।
মিউজিয়াম থেকে গেলাম কায়রোর খান এল খালিলি বাজার। এত বর্ণময় ও প্রাণবন্ত বাজার খুব কমই দেখা যায়। চারদিকে নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে। জালেবিয়া (ম্যাক্সি ধরণের পোশাক), নানা রকমের সুগন্ধী, পিরামিডের ছোট ছোট সংস্করণ, আনুবিস, নেফারতিতি, আমুন, হাথুর (গো দেবতা-এর মূর্তি। ছোট ছোট কফির দোকান, সেখানে দোকানের বাইরে চেয়ার পেতে লোকজন টার্কিশ অথবা ইজিপ্শিয়ান কফি খাচ্ছে। ছবি তুলতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য স্বর্গ। দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে ঘন্টাখানেকের বেশি থাকতে পারলাম না। তারপর গিজার হোটেলে রাত্রিযাপন।
পরের দিন বাসে করে রওনা হলাম আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে। ছবির মতো শহর আলেকজান্দ্রিয়া। শহরটি ভূমধ্যসাগরের ধারে অবস্থিত। দেখলাম, ক্যাটাকম্বের কবর, যেখানে গোলাকৃতি সিঁড়ি দিয়ে ভূগর্ভে নেমে কফিন রাখার প্রকোষ্ঠগুলি রয়েছে। দেখলাম পম্পেই পিলার। ২৫ মিটার উঁচু পিলার (থাম্বা), অপূর্ব চিত্র আবার। আলেকজান্দ্রিয়ায় এখনও ট্রাম চলে। পুরনো শহর, কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য। এরপর সমুদ্রপ্রান্তে ক্যাটবে সিটাডেল দুর্গ দেখলাম। সবশেষে বিবলিওথিকা আলেকজান্দ্রিনা গ্রন্থাগার দেখে আলেকজান্দ্রিয়া সফর শেষ করলাম। মধ্যাহ্নভোজন সেরেছিলাম স্টিকি রাইস,বেকড ফিশ ও এগ প্ল্যান্ট কারি দিয়ে।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ফার্স্ট ক্লাস ট্রেনে করে রওনা হলাম আসওয়ানের উদ্দেশে। অদ্ভুত সুন্দর ছোট্ট ট্রেনটি। আট-দশটি কম্পার্টমেন্ট। প্রতিটা কম্পার্টমেন্টে আটটি করে কুপ, যেখানে দুজন করে থাকতে পারে। আরামদায়ক ও পরিষ্কার শয্যায় গা এলিয়ে দিলাম। কামরার মধ্যেই মুখ ধোয়ার বেসিন ও তোয়ালে। রাতের খাবার ট্রেন থেকেই দিল।
সকাল আটটায় পৌঁছলাম আসওয়ান। ছোট্ট সুন্দর স্টেশন। সেখান থেকে বাসে করে ক্রুজে পৌঁছলাম- ‘দ্য নাইল সাফায়ার। বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে নীলনদে। জাহাজটি একটি পাঁচতারা হোটেল। ভিতরটি মনোরম, রুমগুলি অনবদ্য। প্রত্যেকটি ঘরের জানলা দিয়ে নীলনদের দর্শন মেলে। খাবারের ব্যবস্থা এলাহি- কি প্রাতরাশ, কি মধ্যাহ্নভোজন, কি নৈশভোজন। বিকেলে চারতলার ডেকে বসে হাওয়ায় উড়ে যেতে যেতে খেলাম চা, কফি ও স্ন্যাক্স। সূর্যাস্তের পরে জাহাজ থেকে নেমে আসওয়ান হাই-ড্যাম ও লো-ড্যাম দেখলাম। এরপর বোটে একটি দ্বীপে গিয়ে ফিলি টেম্পল দেখলাম। এটি দেবী আইসিস-এর মন্দির। মন্দিরটি জলের তলায় হারিয়ে গিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জলের তলা থেকে তুলে এনে এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। রাতে ক্রুজে ফিরে বেলিডান্স ও ডারভিশ ডান্স (সূফীদের ঘূর্ণি ডান্স) দেখে ডিনার হলো।
পরের দিন ভোর সাড়ে চারটায় বাসে রওনা হলাম আবু সিম্বলের উদ্দেশে। পৌঁছতে ছ’ ঘণ্টা লাগলো। সাহারা মরুভূমির বুক চিরে এই যাত্রা। অদ্ভুত অনুভূতি। আবু সিম্বল সুদান বর্ডারে লেক নাসেরের ধারে অবস্থিত।এটি হল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে পাহাড় কেটে রামেসিস টু ও রানী নেফারতিতির বিশাল মন্দির বানানো হয়েছে। বিশালাকায় মূর্তির নীচে আমরা যেন পিঁপড়ের সমান। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ।দুপুরে ক্রুজে ফিরতেই ক্রুজ তার যাত্রা শুরু করল ‘ইডফু-র দিকে।
সন্ধ্যেবেলায় একবার জাহাজ থামিয়ে কমোম্বো টেম্পল দর্শন করলাম। এটি দেবতা ভ্রাতৃদ্বয় সোবেক ও হারোয়েরিস-এর জোড়া মন্দির। তার সঙ্গে কুমির মিউজিয়ামও দেখলাম। শেষে ক্রুজে ফিরে ডিনার ও রাত্রিযাপন। ভোর সাড়ে তিনটেয় জাহাজ পৌঁছল ইডফুতে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় টাঙ্গা করে ইডফুর টেম্পল দেখলাম। হাড়হিম করা হাওয়ায় জমে যাচ্ছিলাম। টাঙ্গাওয়ালা একটি বাচ্চা ছেলে। ভারতীয় শুনে বারবার শাহরুখ খানের নাম আমাদের কাছে আওড়াচ্ছিল। শাহরুখ খান….ইন্ডিয়ান….। ইডফু টেম্পলটি হল দেবতা হোরাসের মন্দির।এটি একটি সুসংরক্ষিত মন্দির, খুব সুন্দর, স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি।
তার পর ক্রুজে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সাঙ্গ হল। দুপুরে হঠাৎ দেখি জাহাজ ঘিরে শোরগোল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ছোট ছোট ডিঙি নৌকা জাহাজটিকে ঘিরে ধরেছে। এরা সবাই বিভিন্ন মিশরীয় সামগ্রী বিক্রি করছে ডিঙি থেকেই। বিছানার চাদর, তোয়ালে, নানা রকম পোশাক ইত্যাদি। একটু উৎসাহ দেখালেই প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে জিনিসগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে জাহাজের জানলা দিয়ে রুমের মধ্যে। দেখার জন্য। পছন্দ হলে টাকা দাও, তাও প্লাস্টিকের পুঁটলির মধ্যে ভরে নৌকায় ছুঁড়ে দিতে হবে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো।
সন্ধ্যেবেলায় লাক্সারে জাহাজ ভিড়ল। আমরা নেমে গেলাম আবু এল হাকাক স্কোয়ারে। লাক্সার বাজারে আবার এক বর্ণময় অভিজ্ঞতা। এ যেন চারপাশ দিয়ে মিশর ধেয়ে আসছে। বাজারে নানারকম জিনিস প্রচুর বিক্রি হচ্ছিল। খেজুর, প্যাপিরাসের পেন্টিং, রূপোর গয়না ইত্যাদি। তারপর ক্রুজে ফিরে ডিনার।এটাই ক্রুজে শেষ রাত।
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় ক্রুজ ছেড়ে মালপত্র নিয়ে বাসে করে বেরিয়ে পড়লাম নীলনদের পশ্চিম প্রান্তে ভ্যালি অফ কিংস-এর উদ্দেশে। এটি হল পাহাড় কেটে বানানো মিশরীয় বংশের বিভিন্ন রাজাদের কবর। মোট তেষট্টি খানা কবর-আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। চারদিকে পর্বতমালা। এক-একেকটি পাহাড়ে এক-একেকটি প্রবেশ পথ। বিশালত্বে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। এখানেই তুতানখামেনের মমি রাখা আছে একটি গুহায়। সেখান থেকে রানী হাচেপসুটের মরটুয়ারি টেম্পল-এ গেলাম। মাঝে ইন্ডিয়ান রেস্তোঁরায় ‘লাঞ্চ’ সেরে পৌঁছলাম নীলনদের পূর্ব প্রান্তে, করনাক টেম্পল-এ। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মন্দির। এটি আমুন, মুত ও খনসুর মন্দির। গ্র্যানাইট, স্যান্ডস্টোন ও লাইমস্টোনে তৈরি এই মন্দির অতি বিস্ময়কর! এতটাই উঁচু যে ঘাড় উঁচু করেও এটির যে থামগুলি রয়েছে, তার শৃঙ্গগুলি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। অসাধারণ কারুকার্য।
এরপর লাক্সার টেম্পল, একই ধাঁচে তৈরি, খুবই সুন্দর।
তার পর রাত সাড়ে দশটায় আমরা প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে হুরগাদা শহরে এলাম। হুরগাদা একটি সৈকত শহর। রেড সি-র ধারে অবস্থিত। সেখানে নৈশভোজ করে বিশ্রাম। পরদিন সকালে উঠে গেলাম হুরগাদা বিচে। অপার্থিব সৌন্দর্য। রেড সি-র জল পান্না সবুজ, ক্রিস্টালের মতো পরিষ্কার। সমুদ্রে কোনও ঢেউ নেই, স্থির। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। পাঁচতারা হোটেলের বিলাসিতা ছেড়ে সমুদ্র সৈকতেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল। ডিসেম্বর মাসের রোদ্দুর–বড়ই মনোরম। দিনটা হুরগাদায় কাটালাম।
পরদিন সকালে বাসে করে রওনা হলাম। গন্তব্য কায়রো। দুপুর একটায় কায়রো হয়ে গিজা পৌঁছলাম। পিরামিড দর্শন হল। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এটি অন্যতম। অনন্য অনুভূতি। তিনটি বড় (কিওপস, খাপরে, মেনকাউরে) ও তিন রানীর তিনটি ছোট পিরামিড দেখলাম তারপর স্ফিংস্- মানুষমুখো সিংহ, একটি বিশাল চুনাপাথরের খন্ডকে খোদাই করে বানানো, অতুলনীয় এই নির্মাণ। সারাজীবন যেন এই দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। সাঁঝেরবেলা পিরামিড চত্বরে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখে খেয়েদেয়ে সোজা হোটেল। পরদিন তো ফেরা। শেষ দিন কায়রো বিমানবন্দর এলাম অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে। এত ভালো ভ্রমণ আমি আগে কখনো করিনি। মিশরীয়দের ব্যবহারে আমি মোহিত। ওরা খুবই অতিথিপরায়ণ ও ভদ্র। আবার ফিরে আসব –এই অঙ্গীকার করে কায়রো বিমানবন্দরে মিশর সফর শেষ করলাম।