রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব
বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশেই কভিড মহামারী এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তবে মালয়েশিয়ায় মহামারী শুধু স্বাস্থ্য খাতেই চাপ ফেলছে না, একই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে বড় এক রাজনৈতিক সংকটেরও। মহামারীকালীন জরুরি অবস্থা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন দেশটির রাজা সুলতান আবদুল্লাহ আহমদ শাহ ও প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। দুজনের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব এখন দেশটিকে বড় এক সাংবিধানিক সংকটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের।
করোনা মহামারীর কারণে মালয়েশিয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় গত ১২ জানুয়ারি। গত রবিবার পর্যন্ত এ জরুরি অবস্থা চালু থাকার কথা ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে দেশটিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী তাকিউদ্দিন হাসান এ জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে এ-সংক্রান্ত ঘোষিত ছয়টি অধ্যাদেশ বাতিলেরও ঘোষণা দেন তিনি। এক মন্ত্রিসভা বৈঠকের ভিত্তিতে এ জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয় বলে জানান তিনি।
এ ঘোষণার পর পরই মালয়েশিয়ার রাজপ্রাসাদের পক্ষ থেকে একটি জরুরি বিবৃতি ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, রাজার সম্মতি ছাড়াই এ জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো অধ্যাদেশ জারি ও বাতিল করার ক্ষমতা শুধু রাজার। গত ২৬ জুলাই পার্লামেন্টে বলা হয়েছে, সরকার জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত রাজার সব অধ্যাদেশ বাতিল করে দিয়েছে। রাজা পার্লামেন্টে জরুরি অবস্থা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও আমলে নেয়া হয়নি। বিষয়টি তাকে মর্মাহত করেছে। এ বিষয়ে রাজার জোর মতামত হলো, মন্ত্রীর পার্লামেন্টে দেয়া বক্তব্য সঠিক নয় এবং এর মাধ্যমে এমপিদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে পার্লামেন্টে এ ঘোষণা দেয়ার সময়ে বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদরা জানতে চেয়েছিলেন, এ অধ্যাদেশ বাতিলে রাজার কোনো সম্মতি রয়েছে কিনা। সে সময় তাকিউদ্দিন হাসান বলেছিলেন, এ বিষয়ে তিনি পরবর্তী সোমবার (গত ২ জুলাই) আলোচনা করবেন।
তবে এ নিয়ে পার্লামেন্টে কোনো ধরনের আলোচনার আগেই বৃহস্পতিবার রাজপ্রাসাদের পক্ষ থেকে এ বিবৃতি দেয়া হয়। বিষয়টি বিপাকে ফেলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে। তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা।
বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টে উত্তপ্ত বিতর্কের আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে এর আগেই শনিবার পার্লামেন্টের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। এ নিয়ে মালয়েশীয় আইনপ্রণেতাদের কাছে একটি নোটিস পাঠানো হয়। ডেপুটি স্পিকার রাশিদ হাসনোনের জারি করা ওই নোটিসে বলা হয়, মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশটির পার্লামেন্টকে কভিড-১৯ সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতেই পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সদস্যদের মধ্যে কভিড শনাক্ত হয়েছে মাত্র ১১ জনের। হাউজে উপস্থিত আইনপ্রণেতাদের সংখ্যার বিপরীতে এ হার দশমিক ৯ শতাংশ। বিরোধীরা বলছেন, মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের দলের সদস্য রাশিদ হাসনোন বর্তমানে এ মহামারীকে পার্লামেন্টের বিতর্ক ঠেকানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে বিরোধী দল এমনকি জোট সরকারের অংশীদারদের পক্ষ থেকেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত দেশটিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এ অচলাবস্থায় মালয়েশিয়ার রাজপ্রাসাদ ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের দেড় বছরের মাথায় মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি এখন প্রায় সবদিক থেকেই ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের পরে মহামারীর ভয়াবহতা মালয়েশিয়ায়ই সবচেয়ে বেশি।
জুনের শুরুর দিকে দেশটিতে তৃতীয়বারের মতো লকডাউন ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এ লকডাউন চালু রয়েছে। মালয়েশিয়ার সরকার জানিয়েছে, দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে নামলেই কেবল এ লকডাউন তুলে নেয়া হবে। তবে দেশটিতে বর্তমানে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ৮-১০ হাজারের মধ্যে রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে তা চার হাজারের নিচে নামার কোনো সম্ভাবনাই নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ মহামারী নিয়ন্ত্রণই বর্তমানে মালয়েশিয়ার রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন অনেকটা বেকায়দায় রয়েছেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার বৃহত্তম এবং ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) নেতা আহমাদ জাহিদ হামিদি ঘোষণা দিয়েছেন তার দল মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের সরকারের সঙ্গে আর থাকছে না। ওই সময় তিনি বলেন, তার দল একটি ‘ব্যর্থ’ প্রশাসনের অংশ হয়ে থাকার বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না।
মালয়েশিয়ায় প্রায় ৬১ বছর শাসন করা দল ইউএমএনও বর্তমানে বহুধবিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলটির একাংশ বর্তমানে মুহিউদ্দিনকে সমর্থন দিচ্ছে। আরেক অংশ বর্তমানে জাহিদ হামিদি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের নেতৃত্বে মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের অনুসারী হিসেবে পরিবর্তিত। তবে পার্লামেন্টে বর্তমান সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে হলে ইউএমএনওর সমর্থন ছাড়া মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পক্ষে তা কোনোদিনই সম্ভব হবে না।
পরবর্তী সময়ে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন এক বিবৃতিতে দাবি করেন, এ বিষয়ে রাজাকে এরই মধ্যে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানানো হয়েছে। এবং জরুরি অবস্থা তুলে নিতে হলে পার্লামেন্টে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে মালয়েশিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য স্টারে সম্প্রতি রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার জোসেলিন তান লিখেছেন, এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে আলোচনা ও ভোটাভুটিতে সরকারের অনীহাকে প্রাসাদের প্রতি মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের চোখরাঙানি হিসেবেই দেখছেন রাজা।
বিশ্লেষকদের মতে, পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে যেত আইনপ্রণেতাদের কতজন প্রকৃতপক্ষে মুহিউদ্দিনের সঙ্গে রয়েছেন। অন্যদিকে মুহিউদ্দিনের প্রধান বিরোধী আনোয়ার ইব্রাহিম ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মাহাথির মুহাম্মদ বর্তমানে মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে এমন কোনো ভোটাভুটি হতে না দেয়া, যাতে পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার পক্ষে অধিকাংশ এমপির সমর্থন নেই।