বাংলাদেশের চায়ের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও কমে যাচ্ছে রফতানি থেকে আয়। সংশ্লিষ্টরা বলছে, দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধির কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
চা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত দশ বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে দেড়গুণেরও বেশি। পক্ষান্তরে রফতানি কমেছে অর্ধেকের মতো। অর্থাৎ ২০১২ সালে যে পরিমাণ চা রফতানি হয়েছে ২০২১ সালে এসে হয়েছে তার অর্ধেকের সামান্য বেশি।
অন্যদিকে টাকার হিসেবে ২০১২ সালে চা রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ২২ কোটি টাকার যেটি ২০২১ সালে নেমেছে ১৮ কোটি টাকায়।
যদিও এর মধ্যে ২০১৭ সালে ৩৭ কোটি টাকার এবং ২০২০ সালে ৩৪ কোটি টাকার চা রফতানি হয়েছিলো।
চা ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন যে দেশের মধ্যে চায়ের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ার কারণে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য খুব বেশি চা অবশিষ্ট থাকছে না।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশে রফতানি বাড়াতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশে জনপ্রিয় জাতগুলোর চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।
এ ভূখণ্ডে চায়ের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালের দিকে। যদিও বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা বাগান হয়েছিলো ১৮৫৪ সালের সিলেটের মালনিছড়ায়।
তবে দেশের উৎপাদিত চায়ের বড় অংশই এখন আসে মৌলভীবাজারের বাগানগুলো থেকে। দেশের যত চা উৎপাদন হয় তার ৫৫ ভাগই আসে এই জেলার বাগানগুলো থেকে।
সিলেট অঞ্চলের বাইরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে আসে উৎপাদিত চায়ের দশ ভাগ।
গত জুনে চলতি বছরের চা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উৎপাদন বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেয়ায় ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, যা দেশের জন্য এ যাবতকালের সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড।
দেশে চা বাগান কত, উৎপাদন কেমন হয়
বাংলাদেশের চা বোর্ডের হিসেবে এ মুহূর্তে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান ও টি এস্টেট আছে। তবে এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১২৯টি বাগান ও টি এস্টেট।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চা বাগান হতে গেলে ন্যূনতম ২৫ একর জমির বাগান লাগে। অন্যদিকে এস্টেট হল চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও শ্রমিক কর্মচারীর মৌলিক সুযোগ সুবিধাসহ চা বাগান।
সব মিলিয়ে সে হিসেবে বাংলাদেশে ২ লাখ ৮০ হাজার একর জমির নিবন্ধিত বাগানে চা চাষ করা হচ্ছে।
দেড় দশক আগেও দেশে চা আমদানির পরিমাণ ছিল ৭০ থেকে ৮০ লাখ কেজি। প্রতি বছর বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে সেই আমদানির পরিমাণ এখন ৮/৯ লাখ কেজির নিচে নেমে গেছে।
মূলত ২০০১ সাল থেকেই দেশে ধারাবাহিকভাবে চা উৎপাদন বেড়েছে। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৩ লাখ কেজির মতো।
প্রতিবছর এই উৎপাদন বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিরও বেশি।
সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ কোটি কেজি।
উৎপাদন বাড়লেও কমছে রফতানি, কারণ কী
বাংলাদেশ ট্রি ট্রেডার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ওমর হান্নান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, দুটি কারণে উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি সত্ত্বেও রফতানি কমেছে।
এগুলো হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা উৎপাদন হারের মতোই বেড়ে যাওয়া আর বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেই ভালো দাম পাওয়া।
‘উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। আর আমি যখন লোকাল বাজারেই ভালো দাম পাচ্ছি তাহলে আমি আন্তর্জাতিক বাজারে যাবো কেন? এখানে সেটাই হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এর সাথে একমত পোষণ করেছেন বাগান মালিক সমিতিও।
চা ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় একটি প্রতিষ্ঠান হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে সরকারি সহায়তা পেলে বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন আরও বাড়ত, যা রফতানি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতো।
তার মতে দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার প্রেক্ষাপটে নগরায়ন বেড়েছে যে কারণে চায়ের ভোক্তা সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
এ কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা আর উৎপাদন এখন প্রায় সমান সমান বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
চা বোর্ডের হিসেবে ২০০১ সালে চা রফতানি থেকে আয় হয়েছিলো ৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
মাঝে দু এক বছর কিছুটা বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০২১ সালে এসে রপ্তানি থেকে এসেছে ১৮ কোটি টাকা।
তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চায়ের ভালোই চাহিদা আছে বলে দাবি করছেন এখানকার কর্মকর্তারা।
এ মুহূর্তে চীন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ২৩টি দেশে বাংলাদেশের চা যাচ্ছে।
এবার চা দিবসের অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও বলেছিলেন যে বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী চা রফতানি করা যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন যে দেশে এখন উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজির মতো। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদাই আছে সাড়ে দশ কোটি কেজিরও বেশি, যা ক্রমশ বাড়ছে।
অর্থাৎ দেশেই প্রতি বছর চাহিদার তুলনায় ১ থেকে ২ কোটি কেজি চায়ের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
মূলত এ কারণেই চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
চাষ হচ্ছে সমতলেও
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি বাড়ানোর জন্য নানামুখী পরিকল্পনার কথা আগেই জানিয়েছে সরকার।
লক্ষ্য অর্জনে ও চাহিদা মেটাতে পাহাড়ি উঁচু জমির পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতল জমিতেও চা চাষ হচ্ছে যা চায়ের মোট চাহিদার দশ শতাংশেরও এর বেশি পূরণ করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পঞ্চগড় জেলায় ১৯৯৬ সালে প্রথম চা চাষের বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়।
এরপর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উঁচু ভূমি। যেন বৃষ্টি হলেও দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়ে যায়।
এ কারণে এত দিন চা চাষের জন্য পাহাড়ি উঁচু ভূমিই বেছে নেয়া হতো। কিন্তু এখন সমতল ভূমিতেও ভালো চা হচ্ছে যা দেশের মোট চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখছে।
আবার কিছু উচ্চ ফলনশীল জাতের চাও উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের হিসেবে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৭৩৫ কেজি চা উৎপাদন হতো। সেই উৎপাদন বেড়ে এখন জমিভেদে প্রতি একরে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে পাঁচ মাস শুষ্ক মৌসুম ,এই সময়ে চায়ের ফলন ঠিক রাখতে খরাসহিষ্ণু চায়ের নতুন দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে চা গবেষণা ইন্সটিটিউট।
এই উচ্চ ফলনশীল ও খরাসহিষ্ণু জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত বিতরণ করা গেলে উৎপাদন আরো বাড়বে বলেও আশা করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি