Home Third Lead সংকট না থাকলেও যেভাবে অস্থির চালের বাজার

সংকট না থাকলেও যেভাবে অস্থির চালের বাজার

ছবি সংগৃহীত

 লিয়াকত আলী বাদল: শস্যভান্ডার খ্যাত এবং ধান চাল উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এলাকা বলে পরিচিত রংপুরে ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কেজিপ্রতি চালের প্রকার ভেদে ৬ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়েছে। আড়তগুলোতে হাজার হাজার বস্তা চাল থাকলেও চালের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আড়তদার ব্যবসায়ীরা নিজেরাই সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে গত এক সপ্তাহে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে আকস্মিক চালের দাম বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। চালের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অনেক পরিবার তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা ভাত খেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিভাগীয় নগরী রংপুরের দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম রংপুর সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে গিয়ে দেখা গেছে, মোটা ৪০ টাকার চাল কেজিপ্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশী স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন কেজিপ্রতি ৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট ৬০ টাকা কেজির চাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ ৫৪ টাকার চাল ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আড়তদাররা বলছেন, বড় বড় মিলাররা হাজার হাজার বস্তা চাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় চালের দাম বেড়েছে। তারা বড় বড় মিলারদের দায়ী করলেও সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে ব্যবসায়ীদের গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল অবৈধভাবে মজুদ রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিন দেশের অন্যতম চালের পাইকারি মোকাম রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ ও নগরীর বড় চালের আড়ত সিটি বাজার ঘুরে চালের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে যে চালের দাম ছিল তা রাতারাতি কেজিপ্রতি ৬ থেকে ১০ টাকা কেন বৃদ্ধি পেল এর সুনিদৃষ্ট উত্তর কোন আড়তদারই দিতে পারেননি।

যেভাবে চালের বাজার অস্থির এবং শত শত কোটি টাকা লুট করছেন আড়তদার ব্যবসায়ীরা

রংপুর নগরীর সিটি বাজারে চালের বড় আড়তদাররা তাদের গোডাউনে হাজার হাজার বস্তা বিভিন্ন ধরনের চাল মজুদ করে রাখলেও তারা রাতারাতি সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বড় আড়তদার আফজাল হোসেনের আড়তে তাকে পাওয়া না গেলেও তার ম্যানেজার আফজাল শরীফ স্বীকার করেন, এক মাস ধরে তাদের গোডাউনে দুই হাজারেরও বেশি চাল মজুদ ছিল। এর মধ্যে হাজার খানেক বস্তা চাল বিক্রি হয়েছে। আবারো হাজারেও বেশি বস্তা চাল তারা কিনেছেন। কিন্তু অনেক আগের কেনা চাল কেমন করে দুই দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৬ থেকে ১০ টাকা দাম বাড়ল তার কোন ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। একইভাবে আরেক বড় আড়তদারের ম্যানেজার সাহেব আলী জানালেন একই কথা। তাদের গোডাউনে দেড় দুই হাজার বস্তা চাল সব সময় মজুদ থাকে। এখান থেকে চাল বিক্রি হয় আবার চাল নিয়ে আসেন দিনাজপুর নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলা থেকে। এক সপ্তাহ আগে তাদের আগের দামে কেনা চাল থাকার পরও কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা চালের দাম বাড়ল কিভাবে তার উত্তরে তিনি জানান, আমাদের আগের দামে চাল কেনা থাকলেও এখন বড় বড় মোকামে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কেন আগের দামে আগে থেকে স্টক করে রাখা চাল বিক্রি করা হলো না তার কোন ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। তিনি মালিকের আদেশ বলে চালিয়ে দিলেন।

একইভাবে দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় শতাধিক চালের আড়তদার ব্যবসায়ী রয়েছেন সেখানেও অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার বস্তা চাল আগের দরে কেনা রয়েছে। সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামের চালের আড়তদাররা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে এক সঙ্গে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গত ৭ দিনে এমন অভিযোগ ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীদের। মূলত চালের বাজার অস্থির করার নেপথ্যে অল্প কিছু বড় আড়তদার ব্যবসায়ী আর মিলার রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রংপুর চাল উৎপাদনে দেশের মধ্যে অন্যতম উদ্বৃত্ত এলাকা বলে পরিচিত। বোরো ধানের ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কোন কারণ নেই বলে এটা সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি বলে অবসরপ্রাপ্ত কৃষি বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ আলমগীর হায়দার জানিয়েছেন।

কৃষি কর্মকর্তারা যা বলছেন

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, রংপুর জেলা সব সময় ধান চাল উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এলাকা। প্রতি বছর শুধুমাত্র রংপুর জেলা থেকে উৎপাদিত সাড়ে চাল লাখ মেট্রিক টন চাল দেশের অন্য জেলার চাহিদা মিটিয়ে থাকে। তিনি জানান, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর জেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমি। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে চাষ হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬১ হাজার ৭৭৭ মেট্রিক টন চাল। আশা করা হচ্ছে উৎপাদন এর থেকে বেশি হবে কম হবে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রংপুরে জেলার সব জমির ধান কাটা সম্পন্ন হবে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, রংপুর জেলার মানুষের বোরো চালের চাহিদা রয়েছে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। সেখানে আড়াই লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি চাল উদ্বৃত্ত থাকবে যা দেশের অন্যন্য জেলার চাহিদা মেটাবে। সেখানে ভরা মৌসুমে অন্য জেলার কথা বাদ দিলাম, রংপুরে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোন কারণ নেই। এটা সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত জানিয়ে বলেন, খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোন কারণ নেই।

এদিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ, শ্রমজিবীসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। রিকশাওয়ালা সাজাহান, কুলি নবাব আলী জানান, আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৪০ টাকার মোটা চচাল ৫৮ টাকায় উঠেছে, ফলে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা আধা পেট করে ভাত খেকে হচ্ছে তাদের। একই কথা জানালেন গৃহবধূ সালমা বেগম। তিনি বললেন, যেভাবে চালের দাম বাড়ছে তাতে তাদের পক্ষে চলা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে তিনি জানান।-সূত্র: সংবাদ