উর্বর ও নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি। বিশ্বে এমন কোনো ফল-ফসল নেই, যা বাংলাদেশে ফলে না। বোধ করি তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ পার্বতীপুরের দেড় বছর বয়সী এক চা-বাগান। এখানকার মানুষ কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি পার্বতীপুরের মাটিতে চা’য়ের চাষ হতে পারে। তবে, এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, এ মাটিরই এক তরুণ উদ্যোক্তা জুলফিকার হক জুয়েল (৪০)। পেশায় একজন ব্যাংকার হলেও তারই নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী বেলাইচন্ডি ইউনিয়নের বাঘাচড়া মৌজার হরিতকিতলা গ্রামে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ২ একর জমি ২০ বছরের জন্য লীজ নিয়ে তার উপর তিনি গড়ে তোলেন ছোট আকারের এক চা-বাগান। সবাই জানতো ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা সমন্বিত সিলেট, মৌলভিবাজার ও চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোথাও চা’য়ের বাগান করা সম্ভব নয়। তবে, সর্বপ্রথম এ সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে পাহাড় বেষ্টিত দার্জিলিংয়ের সন্নিকটে পঞ্চগড়ের মানুষ সমতল ভূমিতে চা বাগান করে দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়। এর প্রভাবে বর্তমানে চা চাষ পাশের জেলা নীলফামারী ও লালমনিরহাটেও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাগান থেকে চা পাতা সংগ্রহ করছেন শ্রমিকরা। এসময় কথা হয় জুলফিকার হকের সঙ্গে। তাঁর ব্যাংকার থেকে চা বাগান মালিক হওয়ার গল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ২০১৮ সালে পঞ্চগড়ের দেবিগঞ্জ উপজেলার ভাউলাগঞ্জে ন্যাশনাল ব্যাংকে শাখা ব্যবস্থাপক পদে যোগদান করেন। সে সময় চা বাগান মালিক ও চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের উৎসাহ ও পরামর্শে চা বাগানের মালিক হন জুলফিকার হক জুয়েল। তার চা-বাগান থেকে এ পর্যন্ত তিনি তিনবার চা পাতা আহরণ করেছেন। প্রথম বার পেয়েছেন ৮শ’ কেজি চা পাতা পরের বার ১১শ’ কেজি এবং ৩ জুলাই রবিবার ১৫শ’ কেজি (দেড় টন) চা পাতা আহরণ করেন।
২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ (ডিগ্রী) ধারী উচ্চ শিক্ষিত এ তরুণ উদ্যোক্তা জানান, চা-চাষে তার অভিজ্ঞতা স্বল্প সময়ের হলেও ইতিমধ্যে চা-চাষের অনেক খুটিনাটি বিষয় তিনি রপ্ত করেছেন। বাংলাদেশে সাধারণত বিডি-২ ও ২৩ জাতের চা সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাষ করা হয়। তবে, এ চায়ের মান ভালো হলেও ৬০ দিনের মাথায় এর উৎপাদনশীলতা সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে, পঞ্চগড়, লালমনিহাট ও নীলফামারী অঞ্চলে চা ২৫ থেকে ২৬ জাতের চাষ করা হয়। এ চায়ের মান উন্নত না হলেও ৪৫ দিনে আহরণ উপযোগি হয়ে ওঠে।
শুরুতে তিনি পঞ্চগড় থেকে চায়ের চারা সংগ্রহ করেন। এতে দুই একর জমি লীজ, চারা বীজ ক্রয়, সার, পরিবহন, শ্রমিক মজুরীসহ তার ব্যয় হয় প্রায় ৭ লাখ টাকা। তিনি বলেন, একবার বীজ রোপন করলে ১০০ বছর পর্যন্ত চা আহরণ করা যায়। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে প্রতি কেজি চা পাতা ১৫ থেকে ১৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে, প্রতি কেজি চায়ের মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা হলে সব মিলিয়ে চা চাষ লাভজনক হতে পারতো। তার বাগানের উৎপাদিত কাঁচা চা-পাতা তিনি পঞ্চগড় জেলার দেবিগঞ্জের পপুলার চা কারখানায় বিক্রি করছেন। চা-বাগান সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি আরও জমি খুঁজছেন। ইতিমধ্যে আরও ১ একর জমি বন্দোবস্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আরও জমি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। পার্বতীপুরে চা-চাষের উপযোগি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি রয়েছে।
তিনি তার চা-বাগানের আয়তন আরও বাড়াতে চান। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে চা-বাগান ব্যবসায় শরিক হয়েছেন। তার সহকর্মী ব্যাংকার সোহাগ সরকার, ব্যবসায়ী বন্ধু রাজিব হোসেন ও পরার্মশক ময়েজ উদ্দীন। তারা জানান, চা-বাগানের ব্যবসা ব্যয় বহুল হলেও লাভজনক। এক্ষেত্রে ক্ষতিকর লালমাকড়, চায়ের মশা, লোভার পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।