চা বাগিচার কড়চা: পর্ব ১
অপূর্ব দাশগুপ্ত: আমাদের বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকত প্রায় এক বিঘে জমির ওপর। বর্গক্ষেত্রাকৃতি জমি- খণ্ডটির প্রায় মাঝখানে তার অবস্থান।চুন–সুরকির পাকা দেওয়াল। সিমেন্টের মেঝে, অথচ মাথায় খড়ের আচ্ছাদন। এই খড়ের চালই ছিল আমাদের বাড়ির বিশেষ সৌন্দর্যের অন্যতম কারণ, প্রতি বছর নতুন করে ছাউনি দেওয়া হত আর নতুন করে সেজে উঠত আমাদের বাড়ি। গোটা চার–পাঁচ প্রশস্ত কামরা নিয়ে বাড়িটির আয়তন নেহাত মন্দ ছিল না। সামনে ছিল একটা কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা মস্ত বারান্দা। সেখানে আমরা দু’ভাই, সমবয়সী বন্ধুদের জুটিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট, দড়ি টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করতাম। মাঝে মাঝে আমাদের কাকারাও যোগ দিতেন।
বারান্দা থেকে পাঁচ–ছ’ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসতে হত বাড়ির সামনের দিকটায়। সেখান থেকে শুরু সাদা নুড়ি বিছানো সরু পথ, যা শেষ হয় বাড়ির সীমানা বরাবর গেটে। গেটের ঠিক আগে কাঠের সেতু। সেই শীর্ণ রাস্তাটির দু’ধারে নানা ফুলের সমারোহ। শীতে এই জায়গাটা সবচেয়ে রঙিন হয়ে উঠত। গেট খুলে সামনে চওড়া পথের ওপারেই দিগন্তবিস্তৃত চা–বাগান আরম্ভ, যেন সাড়ে তিন ফুট উঁচু সবুজ মাঠ, মাঠের মধ্যে ইতস্তত ছায়া-দেওয়া গাছগুলি নিশ্চল খেলোয়াড়ের মতো দাঁড়িয়ে।
শীর্ণ রাস্তাটির দু’ধারে নানা ফুলের সমারোহ
আমি যে বাড়িটির কথা এতক্ষণ বলেছি, সেটা আসলে চা–বাগান কর্তৃপক্ষের, অর্থাৎ চা-বাগানের মালিকের, আমার বাবাকে দেওয়া বাসস্থান। একে কোয়ার্টার না বলে আমাদের বাড়ি বলার কারণ, শৈশবে আমরা একে কখনও কোয়ার্টার বলে ভাবিনি। ‘আমাদের বাড়িই’ ভাবতাম। এ ধরনের ভাবনার ফল আমার ও আমাদের বন্ধুদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ভাল হয়নি। যে সময়ের কথা আজ বলতে চলেছি তা বিশ শতকের ছয়ের দশকের শুরু থেকে সাতের দশকের প্রথম কয়েক বছরের কথা।
আমাদের চা-বাগানে বাঙালিদের কোয়ার্টার-সংখ্যা ছিল তেইশ-চব্বিশটি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বাবু-বিবি-সহ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে পাঁচ/সাতজন মানুষের বাস। সুতরাং মোটামুটিভাবে জমজমাট একটা বাঙালি জীবনধারা বয়ে যেত সেখানে। সে প্রবাহকে স্রোতস্বিনী বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সেখানে গা ভাসিয়ে শৈশবের দিনগুলি থেকে জীবনের আঠেরো-উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত এবং স্বপ্নময় দিন কাটিয়েছি। তারপর বহু বছর ধরে ভেবে এসেছি সেই দিনগুলির লিখিত বিবরণী রাখা আমার উচিত, এটা একটা কর্তব্যও বটে। এতদিনে হয়তো সেই অবসর পেলাম।
গত শতকের চারের দশকের শেষ দিকে, বাবা যখন কালচিনি সংলগ্ন ডিমা চা-বাগানে চাকরিতে যোগ দেন, তখন কালচিনি ছিল জলপাইগুড়ি জেলায়। অনেক পরে, ২০১৪ সালের ২৫ জুন আলিপুরদুয়ার স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে চিহ্নিত হলে কালচিনি আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অঞ্চলটির নাম ডুয়ার্স।
ডুয়ার্সের সীমারেখাটি এরকম: ভূটান পাহাড়ের সানুদেশ ধরে পশ্চিমে তিস্তা নদী থেকে পূর্বের সঙ্কোস নদী পর্যন্ত ২২ মাইল চওড়া ও ২০০ মাইল লম্বা যে ভূখন্ড, তার নাম ডুয়ার্স। ব্রিটিশদের আগমনের বহু পূর্ব থেকেই ডুয়ার্সে বসবাস করতেন মোঙ্গল জনজাতির কোচ, রাভা, ক্ষেণ, গারো, টোটো, ভুটিয়া, লেপচা ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এদের জীবিকা ছিল প্রধানত চাষবাস। এ ছাড়া, কিছু হস্তশিল্প ও পন্য-বিনিময় করে এদের দিন কাটত। এরা প্রাচীন জুম পদ্ধতিতে চাষ করতেন। পরবর্তী সময়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান এবং জনজাতিদের মধ্যে অগ্রসর শ্রেণীর মানুষদের উদ্যোগে এ অঞ্চলে আধুনিক চাষাবাদের সূচনা হয়।
যখনকার কথা লিখছি তখন এ অঞ্চলে ধান, মারুয়া, শাকসবজির সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমানে তুলো চাষ হত। তুলোচাষ করতেন প্রধানত ‘গারো’ উপজাতির মানুষ। বস্ত্র-বয়ন শিল্পের চল ছিল মেচ উপজাতিদের মধ্যে। ভুটিয়া ও টোটোরা মজুরের কাজ করতেন। আর গারো-দের আর একটা বিশেষ কাজ ছিল পাল্কি বহন করা। রাভারা অরণ্যজীবন পছন্দ করতেন। এদের একাংশ এখনও হয়তো বনেই বাস করে। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি একবার আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে গন্ধুরের সঙ্গে গভীর বনে গিয়ে এদের দেখা পেয়েছিলাম।
এখন অবশ্য টোটো, ধীমল, ভুটিয়াদের সঙ্গে গারোরাও ডুয়ার্সে নানা কারণে কমে গিয়েছে। তবে ডুয়ার্সের চা-বাগানে শ্রমিক বা কুলি হিসেবে এইসব উপজাতিদের দেখা যেত না। এখানে কায়িক শ্রম দিত আসতেন ছোটনাগপুর থেকে ওঁড়াও, মুন্ডা কোল ইত্যাদি জনজাতির মানুষেরা এবং নেপাল ও দার্জিলিং থেকে আগত আদিবাসীরারা। কেন স্থানীয় বাসিন্দারা চা-বাগান শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়নি, কেনই বা দূরদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করতে হয়েছিল, তার অবশ্যই কিছু অর্থনৈতিক ও সমাজিক কারণ রয়েছে। তবে আপাতত এ প্রসঙ্গ মুলতুবি থাক।
উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চল আদিতে কোচবিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পরে নানা সময়ে ভূটানের সঙ্গে এ অঞ্চলের হাতবদল হয়। শেষে ডুয়ার্সের দখল নেয় ইংরেজরা। খুব সংক্ষেপে এই ঘটনাপ্রবাহ এরকম- আদিতে দক্ষিণে রঙপুর থেকে শুরু করে উত্তরের হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর অসম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কামতাপুর রাজ্য। গৌড়ের আক্রমণে কামতাপুরের খেন রাজত্বের পতন হয়। গৌড়ও দীর্ঘ সময় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। বর্তমান কোচবিহার অঞ্চলটি ছিল প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের শেষ সীমা। পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে রাজা বিশ্বসিংহ এ অঞ্চলে কোচ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কোচ রাজবংশ থেকেই কোচবিহারের নামকরণ। কালের নিয়মে বহিঃ শত্রুর আক্রমণ, অন্তর্কলহ ইত্যাদি কারণে কোচ রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে মুঘল শক্তি কোচবিহারের ওপর থাবা বসায়। প্রতিবেশী ভূটান রাজ্যও একসময়ে কোচেরাই শাসন করত। পরে ভূটানের প্রথম ধর্মরাজ কোচেদের উৎখাত করেছিলেন। তা হলেও ভূটান ও কোচবিহারের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। বছরের একটা সময়ে, বর্ষাকাল এড়িয়ে, ভূটানের ব্যবসায়ীরা নেমে আসতেন সমতলে।
কোচ রাজবংশ থেকেই কোচবিহারের নামকরণ
তখন কোচবিহারের উত্তর সীমা ছিল ঘণ অরন্যে ঢাকা। আর ছিল ছোট-বড় অসংখ্য নদী। শীতে এই নদীগুলি থাকত শান্ত কিন্তু বর্ষায় তারাই হয়ে উঠত ভয়ংকর। যখন জল থাকত না তখন নদীগুলি পাহাড় থেকে নেমে আসার পথ তৈরি করত।এই পথগুলিকেই বলা হত দুয়ার। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি গেট। এই দুয়ারগুলির কারণেই এ অঞ্চলের নাম ডুয়ার্স। আমাদের অনেক সময় খেয়াল থাকে না যে উত্তরবঙ্গের মতো অসমেও রয়েছে এ রকম গিরিখাতের পথ। তাদেরও নাম দুয়ার। মুঘল আক্রমনের সময় ভূটানের রাজা সৈন্য পাঠিয়ে কোচবিহারের রাজাকে সাহায্য করেছিলেন। বিনিময়ে ভূটান দুয়ার এলাকার কর্তৃত্ব আদায় করে নেয়। ধীরে ধীরে ভুটানিরা কোচবিহারে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং কোচবিহারের সিংহাসনের প্রকৃত দাবীদার মহারাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়ণকে বন্দি করে নিয়ে যায়। মহারাজার নাজির খগেন্দ্রনারায়ণ এই পরিস্থিতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য চান।
এদিকে ইংরেজ সীমান্তে ভূটানের এই প্রতিপত্তি কোম্পানি পছন্দ করছিল না। সুতরাং ভূটানকে কাবু করার এবং সেই সঙ্গে কোচবিহারের ওপর প্রভুত্ব বিস্তারের সু্যোগ হেস্টিংস ছাড়তে চাইলেন না। তিনি সৈন্য পাঠিয়ে ভূটানকে হারিয়ে দিলেন। ফলে ভূটানও পরাজিত হল এবং কোচবিহারের ওপরও ইংরেজ-কতৃত্ব স্থাপিত হল। কোচবিহারের রাজস্বের ওপরেও তাদের ভাগ বসল। ১৭৭২ সালে ইংরেজ-কোচবিহার চুক্তি সই হল। প্রথম ইংরেজ-ভূটান যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থেই স্বেচ্ছায় ডুয়ার্স অঞ্চলের ওপর ভূটানের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভূটানকে খুশি রেখে ভূটানের মধ্য দিয়ে তিব্বত পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যপথ সম্পসারণ করা। পরে ১৮৬৫ সালে দ্বিতীয় ইংরেজ-ভূটান যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ডুয়ার্স অঞ্চলে ইংরেজ অধিকার পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারের চুক্তির নাম সিঞ্চুলা চুক্তি।
এখানে বলে রাখি, ব্রিটিশ আমলে ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলার সৃষ্টি। এই জেলা গঠিত হবার পূর্বে বৈকুণ্ঠপুর, বোদা এবং পাটগ্রাম এই তিনটি পরগণা নিয়ে জলপাইগুড়ি, রংপুর জেলার অধীনে ছিল। জলপাইগুড়ি জেলা নির্মাণের সময়ে এই তিনটি পরগণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর একটি অঞ্চল, যাকে আমরা বলি পশ্চিম ডুয়ার্স।
আগেই বলেছি আমার বাবা চারের দশকের শেষদিকে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় ডুয়ার্সের চা-বাগানে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। জলপাইগুড়িতে চা-বাগানের পত্তন কিন্তু হয়েছিল তারও অনেক আগে। ১৮৭৪ সালে ডাঃ ব্রাউহাস গজলডোবাতে প্রথম চা বাগান পত্তন করেন। বাঙালি উদ্যোগপতিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। কিছুদিন পরে বাঙালি ধনী পরিবারগুলিও চা-বাগান পত্তনে আগ্রহী হন। বাঙালি প্রতিষ্ঠিত প্রথম চা-বাগান বানারহাটের মোগলকাটায়। তবে, অন্য একটি পরিসংখ্যান অনুসারে ১৮৯৫ সালে ১৮২টি চা-বাগানের মধ্যে বাঙালি মালিকানাধীন চা-বাগানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১। সে যাইহোক, কালচিনির চা-বাগানগুলি ১৮৯৭ থেকে ১৯০১-০২ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের পরিবার কী করে এই ডুয়ার্সে এসে পড়ল সে গল্পও বলা প্রয়োজন। আমাদের দেশ ছিল বর্তমান বাংলাদেশের পটুয়াখালি। গ্রামের নাম বাসুদেবপুর। আমার দাদার ‘বাসু’ ডাকনামটি এই ফেলে আসা গ্রামের নামে। পটুয়াখালি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমানে এটি একটি জেলা। ১৯৬৯ সালে পটুয়াখালি জেলার স্বীকৃতি পায়। এর আগে ১৮৬৭ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা গেজেটে পটুয়াখালিকে মহকুমা হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা করা হয়। ১৮৬৭ সালে পটুয়াখালি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়েছিল, অর্থাৎ আমাদের পরিবার দেশভাগের সময়কালে পটুয়াখালি একটি মহকুমা। সঠিকভাবে বলতে গেলে পটুয়াখালি ছিল আমাদের দেশের বাড়ি। দাদু তাঁর চাকরির ও ছেলেদের লেখাপড়ার সুবিধার কারণে বরিশালে একটি আস্তানা করেছিলেন। বরিশাল ও পটুয়াখালি মিলেই ছিল তাঁদের জীবনযাপন। দাদু বোধহয় পার্টিশনের আগেই কোলকাতায় পোর্ট কমিশনারে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন। পটুয়াখালিতে ও বরিশালে তাঁদের বাড়ি ও অল্পকিছু জমিজমা থাকলেও আমাদের পরিবারকে দাদুর আমল থেকেই চাকরি নির্ভর হতে হয়েছিল।
বাবাও বরিশালের বি.এম কলেজে পড়াশুনো অর্ধসমাপ্ত রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন ফৌজে কেরানির চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। থাকতেন আর্মহ্রার্স্ট স্টিটের মেসে। দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হবার পর আমাদের পরিবার যে খুব একটা জোরালো হুমকি বা দাঙ্গার মুখোমুখি হয়েছিল, এমন গল্প অবশ্য বড়দের মুখে শুনিনি। বরং প্রতিবেশী মুসলমানেরা নাকি আশ্বাস দিয়েছিল নিরাপত্তার। ঠাকুমা অবশ্য বলেছিলেন কিছু মুসলমান প্রতিবেশীর ব্যবহারে পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। মনে হয় অন্যান্য হিন্দু উচ্চবর্ণের প্রতিবেশীদের অনুসরণে আগামী দিনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া, সে মুহূর্তে স্থানীয় অঞ্চলে বড়সর গোলমাল না হলেও দেশ জুড়ে দাঙ্গা-খুনোখুনির খবর তো মিথ্যা ছিল না।
ইতিমধ্যে মার্কিন সেনারা যুদ্ধশেষে ফিরে যাওয়ায় বাবার চাকরিও আর ছিল না। বাবা নানা স্থানে কাজ জোটাবার চেষ্টা করছিলেন। এদিকে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনাও শুরু হয়েছে। এতবড় পরিবার সবাই কলকাতায় চলে এলে খুবই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, একথাও সকলে বুঝতে পারছিলেন। এই রকম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় বাবার পিসেমশাই জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্সের হাসিমারা থেকে বাবাকে ডেকে পাঠান। তিনি তখন হাসিমারার একটি চা-বাগানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড়বাবু। হাসিমারার সেই বাগানের ম্যানেজারের সুপারিশেই কালচিনির এই চা-বাগানে বাবা কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
আমার মামাবাড়ির পরিবারের আদি বাড়ি ছিল কুমিল্যা। দাদু পোস্ট-অফিসে চাকরি করতেন। কাজের সূত্রে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হত তাঁকে। শেষ যে স্থানটিতে দাদু পোস্টেড ছিলেন, মায়ের মুখে শুনেছি, সে অঞ্চলটি ভারত-ভুক্ত হবার কথা ছিল এবং আমার বড়মাসির তত্ত্বাবধানে ‘জন গণ মন’ অনুশীলনও শুরু করেছিল স্কুলের মেয়েরা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা যায় ওটা নাকি পড়ছে নাকি পূর্ব পাকিস্তানে। তখন সেই গান মুলতুবি রাখা হয়। দাদুও নিজের পছন্দের দরখাস্ত দাখিল করে জলপাইগুড়ি চলে আসেন সপরিবার। আমার মা-মামা-মাসিরা তখন স্কুলের ছাত্র ছাত্রী। দাদু এরপর জলপাইগুড়ির বিভিন্ন শহরে বদলি হয়েছেন।
হাসিমরার সেই ম্যানেজারের সুপারিশেই কালচিনির এই চা-বাগানে বাবা কাজে যোগ দিয়েছিলেন
এদিকে বাবা একটু থিতু হলে আমার দাদু-ঠাকুমা বাবার বিবাহের উদ্যোগ নিলে, কোনও সূত্রে মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। মায়ের মুখে শুনেছি, মা-কে দেখতে আসার কাহিনি। আমার দিদিমা ভেবেছিলেন জনা চার/পাঁচ অতিথি হয়তো আসবেন মাকে নির্বাচন করতে। কিন্তু চা-বাগানের কর্তৃপক্ষকে বলে জোগাড় করা হয়েছিল একটি ট্রাক। আর ট্রাক দেখে উৎসাহে উদ্বেল হয়ে বাবা-কাকা-পিসি-বাবার খুড়তুতো ভাইয়েরা এবং চা-বাগানের বাবার সহকর্মীরাও অনেকেই ট্রাকে উঠে পড়েন। জনা-কুড়ি স্ত্রী-পুরুষকে ট্রাক নামতে দেখে দিদিমা-সহ মামাবাড়ির সকলে দিশেহারা হয়ে পড়েন। কিন্তু তখন আর আয়োজনের উপায় নেই দেখে দিদিমা নাকি চা ও লুচির সঙ্গে অথিতিদের চিনি পরিবেশন করেছিলেন এবং সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, বাবার সহযাত্রীরা সকলে এতেই খুব তৃপ্ত হয়েছিলেন।
আমরা ভাইবোনেরা এ দেশেই জন্মেছিলাম। তবু আমরা যে এখনও কোথায় দেশ ছিল এ প্রশ্নের উত্তরে বরিশাল বলি, তার কারণ ঠাকুরমা-বাবা-কাকাদের দেশের বাড়ির প্রতি সেই মর্মান্তিক টান। আমাদের কাছে তাঁদের গল্পের বেশির ভাগটা জুড়ে থাকত দেশের বাড়ির গল্প। তাঁদের কাছে তাঁদের ঘর-বাড়ি, মাঠ প্রান্তর, খাল-বিল-নদী-নালা, মানুষজনের গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ছোটদের মনে তাঁদের ফেলে আসা দেশের বেশ স্পষ্ট একটা ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল।
এবং কী আশ্চর্য, বহু বহুদিন পরে, ২০১৯ সালে বরিশালে গিয়ে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের যে দৃশ্যাবলি দেখি, তার সঙ্গে বাবা-ঠাকুমা-বর্ণিত ছবি হুবহু মিলে যায়। বাবা অবসর নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ারের বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন আমি ও দাদা তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনার পর তিনি আচ্ছন্ন অবস্থায় আমাদের জিজ্ঞেস করছিলেন, আমাকে কোথায় নিয়ে এলি? আমরা বাড়িতে এনেছি বলায় তিনি চারিদিকে চেয়ে চেনবার চেষ্টা করেন, ক্ষীণ কণ্ঠে বারবার বলতে থাকেন, আমাকে বাড়িতে নিয়ে চল। শেষে আমরা দু’ভাই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি দেশের বাড়ি যাবার কথা বলছিলেন।
চা-বাগানের বাবুদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার বাবার মতোই ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন। আবার অনেকেই ছিলেন যাদের দেশ নদিয়া, বহরমপুর কিংবা কাটোয়া। কিন্তু বাঙাল-ঘটি বিদ্বেষ আমাদের চোখে পড়েনি। বাবা কাকার সহকর্মী বন্ধুরা তাঁদের, আর আমাদের বন্ধুরা আমাদের বরিশালের মুখের ভাষা নকল করে মজা পেত মাত্র। আমাদের ঠাকুমা-বাবা-কাকারা বাড়িতে দেশের ভাষায় কথা বলতেন। বাড়ির বাইরে আমরা কথা বলতাম ডুয়ার্স অঞ্চলে প্রচলিত এক অদ্ভূত শঙ্কর ভাষায়, যা ঠিক বাঙাল ভাষা না, এর মধ্যে কিছু মদেশীয়া পরিভাষাও মিশে থাকত। পরে গঙ্গার এ-পারে এসে আমাদের এই সুন্দর ভাষাটি ভুলে যেতে হয়।
আমরা জন্মেছিলাম চা-বাগানে। ডুয়ার্সের চা-বাগানের বাইরে যে এক বিশাল পৃথিবী রয়েছে, ভূগোল বইয়ের মধ্যেই ছোটবেলায় তা ছিল সীমাবদ্ধ। ডুয়ার্সের বাইরে এক মহাপৃথিবীর অস্তিত্বের কথা আমরা জানতাম, কিন্তু ডুয়ার্সের প্রকৃতি, ঋতু বৈচিত্র, মানুষজন আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, যে সে পৃথিবীর টান তখন আমরা অনুভব করিনি বরং প্রিয় ভূমি ছেড়ে যখন চলে আসতে হল, তখন তার আঘাত আমাদের গভীরভাবে বিঁধে ছিল।
অপূর্ব দাশগুপ্ত: ‘পুরোগামী’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব কর্মকর্তা।
*ছবি সৌজন্য: লেখক ও The Wire, Indiatimes, Tripoto
সূত্র: বাংলালাইভ.কম