Home চা শিল্প এক কেজি চা ৩০০ টাকা, শ্রমিক পায় ৬ টাকা

এক কেজি চা ৩০০ টাকা, শ্রমিক পায় ৬ টাকা

ছবি সংগৃহীত

১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি মেনে না নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশের চা-শ্রমিকরা। তারা দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে অনড় রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে নয়, আইনের মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের দাবি পূরণ করা দরকার।

গত ৯ আগস্ট থেকে চা-শ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট শুরু করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের উপস্থিতিতে বুধবার রাতে শ্রীমঙ্গলে চা-শ্রমিকদের জন্য ১৪৫ টাকা মজুরি ঘোষণা করা হয়। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল তা মেনে নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও শ্রমিকরা তা মেনে নেননি। তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। রোববার তারা বাগান থেকে বেরিয়ে সিলেটের তিন জায়গায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, শ্রমিকরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাবে। আর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে ফোনে পাওয়া যায়নি।

‘সোনা ফলাই, কিন্তু তার ফল আমরা পাই না’ মৌলভীবাজারের বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক ও পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আগনু দাস বলেন, আমরা না খেয়ে ১৪ দিন ধরে ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন করছি। ১২০ টাকা থেকে মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে তা ১৪৫ টাকা করেছে। এটা আমরা মানি না। আমাদের ৩০০ টাকাই দিতে হবে। নেতারা কী বলেছেন তা জানি না। আমরা শ্রমিকরা আন্দোলনে আছি।

তিনি বলেন, ১৪৫ টাকায় সংসার চলবে না। আমার চার সদস্যের পরিবার। এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা। এক কেজি আলু ৩০ টাকা। এরপর লবণসহ অন্য জিনিস আমি কীভাবে কিনব।

তার কথায়, এক কেজি পাতি পাইকারি মালিকপক্ষ বিক্রি করে ৩০০ টাকা। আমাদের দেয় ছয় টাকা। আমরা সোনা ফলাই, কিন্তু তার ফল আমরা পাই না। আমাদের ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করতে পারে না। আমাদের চিকিৎসা হয় না। আমাদের ঘরে টিন দেয়া হয় না। এগুলো সব তাদের দেয়ার কথা।

চা বাগানগুলোকে এ , বি ও সি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানে দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। প্রতি দু’বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৯ সালের পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকরা সপ্তাহে দু’টাকা কেজি দরে তিন কেজি আটা পান। এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেয়ার কথা। একই সাথে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা।

আগনু দাস জানান, কাজ না করলে মজুরি ও রেশন কোনোটাই দেয়া হয় না। আমাদের আবাসন বলতে বস্তি। মৌলভীবাজার বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক চন্দন কুর্মী জানান, শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরির মধ্যেও ফাঁক আছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে ১২০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। এর কম হলে প্রতি কেজিতে ছয় টাকা করে কেটে নেয়া হয়। কিন্তু যদি ২০ কেজির বেশি হয় তাহলে প্রতি কেজিতে মাত্র দু’টাকা বেশি দেয়া হয়।

দেশের ১৬৮টি চা বাগানে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে অস্থায়ী ৫০ হাজার। শ্রমিকরা বাগানেই থাকেন। তাদের অন্য কোনো জায়গায় বাড়ি বা জমি নেই।

‘দাসত্বের জীবনে বাধ্য করা হচ্ছে’

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, মাত্র ২৫ টাকা মজুরি বাড়িয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। তারা যে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করেছেন তাও বর্তমানের বাজার দরের তুলনায় অনেক কম। তাদের দাসত্বের জীবনে বাধ্য করা হচ্ছে। এক কেজি চালের দামই তো ৭০ টাকা। তাহলে তারা বাঁচবে কীভাবে। যে আটা দেয়া হয় রেশনে, তাও সামান্য। এক কেজি চায়ের দাম বাজারে ৫০০ টাকা। তারা দিনে তোলে কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা। তাদের তো এক কেজি চায়ের দাম দেয়া হয়না। আমরা চাই তারা যে ৩০০ টাকা দাবি করেছে সেটাই দেয়া হোক।

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় বলে জানান শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: নাহিদুল ইসলাম। তার দাবি, মালিক-শ্রমিক মিলে মজুরি নির্ধারণ করা হয়।

তিনি বলেন, এবারো মালিক শ্রমিক মিলে করেছে। মালিকরা ১৪০ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি আন্তরিক হয়ে ১৪৫ টাকা দিতে বলেছেন। তাই করা হয়েছে।

তার দাবি, বহিরাগতরা শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক মেনে নিলেও তাকে অপমান করা হয়। তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

১৪৫ টাকা কোন বিচেনায় নির্ধারণ করা হয়েছে, বাজার মূল্য দেখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো আমরা বলতে পারব না। এটা মালিক শ্রমিকদের বিষয়।

ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, শ্রম আইন মেনে মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে এই খাতে মজুরি নির্ধারণ করলে এই সমস্যা হতো না। এখানে ইচ্ছা মাফিক মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ এর সহাকারী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিনও মনে করেন, বাজার দর এবং তাদের প্রকৃত আর কী কী সুবিধা দেয়া হয় তা বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করা দরকার। রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে নয়।

গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, চা বাগানের মালিকরা রেশনসহ আরো যে সব সুবিধার কথা বলছেন বাস্তবে সেগুলো নেই। একজন শ্রমিককে সপ্তাহে তিন কেজি আট দেয়া হয় দুই টাকা দরে। তবে এটা সবার জন্য নয়। যাদের রেশন কার্ড আছে তারা পায়। কিন্তু কাজে না গেলে, অসুস্থ হলে তাদের এটা দেয়া হয় না। আগে তো চা বাগানে স্কুল নিষিদ্ধ ছিলো। তাদের সন্তানরা শ্রমিকই হয়। এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এনজিও পরিচালিত কিছু স্কুল আছে। আর চিকিৎসা বলতে বাস্তবে কিছু নেই। তাদের চাষের জমি দেয়ার কথা থাকলেও এখন দেয়া হয় না। তার কথায়, ‘এখনো চা বাগানে ব্রিটিশ আমলের দাস প্রথা চালু আছে বলেই মনে হয়।’

তবে মালিকরা দাবি করছেন, মজুরির বাইরে তাদের দৈনিক যে সুবিধা দেয়া হয় তার মূল্য ১৭৫ টাকা। তারা ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করলেও ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

চা সংসদ দাবি করেছে, ২০১২ সাল থেকে ১০ বছরে চায়ের নিলাম মূল্যের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ হারে বাড়লেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে মোট ৯৪.২০ শতাংশ। চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকার বেশি দামের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের৷

বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় এক শতাংশ।

সূত্র : ডয়েচে ভেলে