চা বাগিচার কড়চা: পর্ব ৫
আমাদের চা বাগানের মাস্টারমশাইয়ের পুত্র কলকাতায় চাকরি করতেন। তাঁর মেয়েও থাকতেন কলকাতায়। তাঁরা তাই পুজোটা চা বাগানে কাটিয়েই প্রায় প্রতি বছর কলকাতায় চলে যেতেন। তাঁদের বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্ব তখন আমরা পেতাম। সেইসময় আমাদের বন্ধুদের নরকগুলজারের স্থান হত তাঁর বাড়িটি। রাতে তো থাকতামই সেখানে, দিনেও ঘাঁটি আগলে বসে থাকতাম আমরা।
কিন্তু, কী আশ্চর্য, কোনওদিন মদের আসর বসাইনি। অথচ ভুটানের লাগোয়া অঞ্চল হবার সুবাদে বিদেশি লিকারের অভাব সেখানে ছিল না। দামও ছিল শস্তা। অবশ্য শস্তা দরেও কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তখন আমাদের মাসিক হাতখরচ বলে কিছু ছিল না। সংসার চালাতেন মা ও ঠাকুমা, কিছু দরকার হলে তাঁদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে কিছু পেতাম। মদ্যপানের বিরুদ্ধে আর একটা কারণ হয়তো আমাদের মনের অজ্ঞাতে কাজ করত। আমরা ভাবতাম নেশা করে মদেশীয়রা, আমরা তো বাবু। হাড়িয়া খেয়ে পথের ধারে ঝোপেজঙ্গলে মাছি পরিবৃত অচেতন অবস্থায় শ্রমিকদের পড়ে থাকা দেখে আমাদের বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। আমরা মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে জমজমাট আড্ডা দিয়েছি আর খেলেছি তাসের টুয়েন্টিনাইন। মাঝে আমার ও নিতাইয়ের দাবার নেশাও হয়েছিল।
ওখানে রাত্রি জাগরণের জেরে ঘুম থেকে উঠতাম বেলা নটা দশটায়। কিন্তু বিভাবরি জাগরণে কাটিয়ে আমরা কিছু সৃষ্টিকর্মেও হাত দিয়েছিলাম। তারমধ্যে একটি ছিল ‘একটি মোরগের কাহিনী’র সঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্যের আরও কিছু লেখা জুড়ে একটা গীতিনাট্য তৈরি করা। গানগুলিতে সুর দিয়েছিল বাবলু। একেবারে নিজস্ব সুরারোপ। আমাদের ক্লাবে সেটা অনুষ্ঠিত হবার পর নানা চা বাগানের ক্লাবে আমরা ডাক পেয়েছিলাম। আর আমাদের আর এক শিক্ষক সমীরেন্দ্রনাথ পান্ডের লেখা ‘নাট্যকারের ইন্টারভিউ’ বলে একটা নাটক ওই মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে মহড়া দিয়ে মঞ্চে অভিনয় করেছিলাম। এখানেই একদিন পরিকল্পনা হয়েছিল জয়ন্তী পাহাড়ে মহাকালের গুহা অভিযানের।
আসলে আমরা যেটা করেছিলাম, সেটা কিছুটা সাইকেল বাকিটা ‘হাইকিং’, যদিও এই শব্দের সঙ্গে আমাদের তখন পরিচয় ছিল না। পাহাড় চড়ার উপযুক্ত জুতো, মাল বইতে সুবিধা হয় এমন ব্যাগ আমাদের ছিল না, চোখেও দেখিনি তখনও। আমরা যে যার চটিজুতো পরে বাজার করার বড় ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। এইসব অভিযানে একজন করে নেতা থাকে। অভিযানের আয়োজন থেকে সমাপন তার নির্দেশেই চলতে হয়। সে নেতা বটে কিন্তু কর্তা নয়। তার সঙ্গে হাসি-মস্করা চলে, তার সিদ্ধান্ত নিয়ে মজাও করা হয়। কিন্তু শেষমেশ তার কথাকেই মান্যতা দিতে বাকি সকলে প্রস্তুত থাকে। আমাদের এই উজ্জ্বল তারাটি ছিল আমাদের বন্ধু ভোলা। তার নির্দেশেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রস্তুতি আর বিশেষ কি? সকলে বাড়ির ভাঁড়ার থেকেই চাল আর আলু আর খিচুড়ি রান্নার অন্যান্য মশলা নিয়েছিলাম। আর প্ল্যাস্টিকের থালা গ্লাস, প্রাতঃরাশের জন্য রওনা হবার সময় নেওয়া হল পাঁউরুটি, বিস্কুট। ডিমসেদ্ধ তো বাড়ি থেকে দিয়ে দিয়েছিল।
পুজো শেষ হয়েছে। আমরা লক্ষ্মীপুজোর দিনটি বেছে নিয়েছিলাম অভিযানের জন্য। পরিকল্পনা ছিল আমরা জয়ন্তী পাহাড়ের মহাকাল গুহায় যাব। মহাকাল জয়ন্তী পাহাড়ের একটি স্ট্যালেকটাইট গুহা। গুহার ছাদ থেকে চুঁইয়ে পরা জলের খনিজ পদার্থ প্রস্তরিভূত হয়ে ছুঁচলো হয়ে ঝুলে থাকে। নানা আকৃতি নেয়। কোনওটা হিন্দুদের দেব-দেবীর মতো আকৃতি নিয়েছে। এই মহাকাল গুহা, বলাবাহুল্য শিব ঠাকুরের গুহা হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সে সময়ে এই স্থান সত্যিকারের দুর্গম অঞ্চল ছিল। শিব ঠাকুরের আপন দেশে পথঘাট বেশ সর্বনেশেই ছিল বলা যায়। এই সেদিন হালের তরুণ তরুণীদের মহাকাল ট্রেকিংয়ের ভিডিও দেখে হতাশ হলাম। একদল ছেলে জয়ন্তী নদীর পাথর ডিঙিয়ে চলেছে। নদীর উপর অস্থায়ী সেতু রয়েছে, তারা পার হয়ে পৌঁছে গেল। এমনি সহজ সেই ট্রেকিং। এমনটা হওয়াই এখন স্বাভাবিক, তবু এই ভিডিও আমার মনে একটু বাজল। ভাবলাম, সেই আদিমতা কোথায়?
চা বাগানের বাবুদের একটা বিলাসিতা কখনও দেখিনি। পরিবার নিয়ে কোনও বাবু ছুটিতে দূর রাজ্যে কোথাও বেড়াতে গেলেন, এমন দেখতাম না। চাকরিসূত্রে বাগিচা মালিক অনেককিছুই তাঁদের দিত। বিনা পয়সায় জল-আলো-জ্বালানি, প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদি, কিন্তু বেতনের পরিমান ছিল খুবই কম। এই কারণে, বেড়ানো ছিল বাবুদের পক্ষে একটা প্রকৃত বিলাসিতা। তাঁদের বেড়াতে যাওয়া মানে কলকাতায়, আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়িতে পিসির কিংবা বোনের বাড়ি অথবা শশুরবাড়ি যাওয়া। ঘরের এত কাছে যে শৈলশহর দার্জিলিং, সেখানে ভ্রমণ পর্যন্ত নয়। কিন্তু ডুয়ার্স যে নিজেই একটা বেড়াতে যাবার স্থান, বাইরের লোক তখনও সেটা টের পায়নি। আর আমাদের কাছে তো তা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।
তবে হ্যাঁ, প্রতি বছর শীতকালে বাগানের সেই বিখ্যাত হলুদ ট্রাকে করে আমরা কোনও নদীর ধারে, জয়ন্তী কিংবা ভুটানঘাটে পিকনিক করতে যেতাম, ছেলেবুড়ো সব্বাই মিলে। সেটা এক ধরনের বেড়াতে যাওয়াই বটে। সেই একদিন দেখেছি আমাদের মায়েদের ছুটির দিন। কয়েকজন পুরুষমানুষ এগিয়ে আসতেন সেদিনের রান্নার দায়িত্ব নিতে। অন্য পুরুষেরা তাঁদের বলতেন, আপনাদের দিয়ে বাড়িতে রান্না করায় নাকি? নইলে এত নিখুঁতভাবে রান্না সামলাচ্ছেন! মা জ্যেঠিমা-কাকিমারা একসঙ্গে বসে আড্ডা মারতেন। আমরা ছোটরা ঘুরে বেড়াতাম জলে জঙ্গলে। একবার জয়ন্তীতে লাল টোপা কুলের জঙ্গলে ঢুকে এত কুল খেয়েছিলাম, যে দুপুরের আসল খাওয়া পন্ড হয়ে গেল। বড়দের একটা দল হঠাৎ কোথায় যেন গা ঢাকা দিতেন। তারপর ফিরে এসে তারা বড়ই বেসুরে বাজতেন। অকারণে হাসছেন, গাইছেন, নাচছেনও। তাদের কান্ড দেখে আমরা হাসছি, মহিলারা সবাই হাসছে। আজ সমাজ-শাসনের চাপ কোথাও নেই। তারপর সন্ধ্যায় রওনা হয়ে চা বাগানে ফিরে আসতে রাত্রি হত। পরদিন সকালে দেখতাম গতকালের কোনও একজন নাচিয়ে গাইয়ে বাবু গম্ভীর হয়ে অফিস চললেন। আজ আর তাঁদের দেখে হাসাহাসি করা চলে না।
ভ্রমণের শখ এইভাবে তাঁদের কিছু মিটত হয়তো, কিন্তু আমাদের তখন এইটুকুতে অজানার আহ্বানের তৃষ্ণা মিটত না। অতএব জয়ন্তী অভিযান। দলপতির নির্দেশে আমরা আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলাম। শক্ত মোটা দড়ি, ধারালো দা, বেশ কিছু চকলেট বোমা। আমরা ভোলাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই বাজি দিয়ে হবে কী। ভোলা গম্ভীর মুখে বলল, হাতি তাড়াতে হতে পারে। এইভাবে সাম্ভাব্য যত বিপদের কথা উদ্ঘাটিত হতে লাগল, আমাদের রোমাঞ্চ ও উৎসাহ তত বেড়ে যেতে লাগল। ভোলা একদিন আমাদের বলল, জয়ন্তী দিয়ে মহাকাল যাওয়ায় তেমন থ্রিল নেই, লোকাল মানুষেরাই পথ দেখিয়ে দেয়। আমরা বরং রায়মাটাং বিট দিয়ে যেতে পারি। সে কাগজে পেন্সিলের দাগ টেনে আমাদের বোঝায় উল্টোদিক থেকে কীভাবে আমরা যাব। সবারই নিজের সাইকেল ছিল। আমারও ছিল, কিন্তু কদিন আগে সেটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি আমার মণিকাকাকে ধরে তাঁর সাইকেলটা জোগাড় করলাম।
পুরনো হারকিউলিস। খুব যত্নে থাকত না, চালাতে বেশ মেহনত করতে হত। অনন্যোপায় আমি সেটা নিয়েই চললাম সেই লক্ষ্মীপুজোর নির্ধারিত দিনে। আমাদের উপর যে সমস্ত সরঞ্জাম নেবার দায়িত্ব ছিল, আমরা ব্যাগে ভরে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিলাম। কিছু ক্যারিয়ারেও চলে গেল। টাবলুদার উপর ছিল একটা হাঁড়ি নেবার দায়িত্ব, যাতে দুপুরে খিচুড়ি রান্না হবে। টাবলুদা অদ্ভুত উপায়ে হাঁড়িটাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে তার উপরে একটা ঢোলা উইন্ডচিটার পরে নিল। সে যখন আমাদের কিছুটা এগিয়ে থেকে সাইকেল চালাচ্ছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল একজন কুঁজওয়ালা মানুষ সাইকেলে আগে আগে যাচ্ছে। প্রথমদিকে উৎসাহ থাকে প্রবল। কালচিনির লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে সকলে প্রাণপণ প্যাডেলে চাপ দিল। মসৃণ পিচের রাস্তায় বাকিদের সাইকেলে গতির ঝড় উঠল। কিন্তু পুরনো হারকিউলিস গতি তুলতে অনিচ্ছুক। আমি পিছিয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা টের পেয়ে দাদা ও বাবলু পিছিয়ে এসে আমার সঙ্গে চলল। ঘণ্টা দেড়েক পরে আমরা জঙ্গলের মুখে এসে পৌঁছলাম। বাকিরা আগে, আমরা তিনজন একটু পরে।
জায়গাটা সুন্দর। ফাঁকা একটু মাঠের মতো। তার মধ্যে কতগুলি বিচ্ছিন্ন শালগাছ পুরু ঘাসের কার্পেটে দাঁড়িয়ে আছে। পাতাঝরা শুরু হয়নি, তবু কিছু পাতা ঘাসের সবুজ নদীতে নৌকার মতো ভাসছে। এরপর থেকেই ঘন জঙ্গল আরম্ভ। একটা মাটির পথের আভাস জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছে দেখলাম। বুঝলাম এই পথ ধরেই এগুতে হবে। সাইকেল চালানো যাবে এই পথে।
ডিম-পাঁউরুটি ও মিষ্টি দিয়ে জলখাবার হল। এই বয়সে যা পাওয়া যায়, যা খাওয়া যায়, তাই যেন অমৃত। ডিম বা দুধের অভাব আমাদের কখনওই হয়নি। আমাদের সবার বাড়িতেই গরু ও হাঁস-মুরগি ছিল। কিন্তু পাঁউরুটি ছিল মহার্ঘ্য। আমাদের কোম্পানি থেকে র্যাশনে প্রচুর গম দেওয়া হত। আমরা কালচিনি থেকে ভাঙিয়ে আনতাম। সুতরাং হাতে গড়া রুটির প্রাচুর্যে পাঁউরুটি খাওয়া হত না। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের জ্বর হলে কালচিনি থেকে পাঁউরুটি আনা হত। সে যাইহোক, আমরা পুনর্বার সাইকেলে চড়লাম। বেশ কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারলাম যে আমাদের সাইকেল চালাতে অসুবিধে হচ্ছে কেননা আমরা ক্রমশ উপর দিকে উঠছি। তারপর দেখি রাস্তা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইল না। বড় বড় পাথরের সন্নিবেশে ক্ষীণ পথ উপরে উঠছে। মনে হয় এটা শুকনো পাহাড়ি ঝোরা।
আমরা সাইকেল ঠেলে নিয়ে চললাম। বাঁশের বংশধর কোনও গাছের পাতা যাত্রা পথে এসে আমাদের চলার বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আমরা এবার সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল হাতে ঠেলে এগুচ্ছি। আমাদের দলের নিত্যানন্দের বাঁ হাত বেশি সক্রিয়। তার বাঁ হাতের কাটারি পথ পরিষ্কার করতে ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে উঠছে। এতক্ষণে আমাদের মনে হল, এই তো অ্যাডভেঞ্চার! সাদা, লালচে, হলদে পাথর ভেঙে সামনে হাঁটি। একসময় ডান দিকে তাকিয়ে দেখি অতলান্ত খাদ। বুঝলাম আমরা অনেকটা উপরে উঠে এসেছি ইতিমধ্যে। অন্যদের কথা জানি না, আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। ঘাম হচ্ছিল। এক সময় সামনে খানিকটা রৌদ্র-ছায়ায় আলপনা আঁকা সমতলভূমি পাওয়া গেল। সেই পাথুরে ঝোরা হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরে ঊর্ধ্বে পাড়ি জমিয়েছে। সে পথ অনতিক্রম্য। সুতরাং সমতলে নেমে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের সুর শোনা গেল সাধনের কণ্ঠে।
সাধন চা বাগানের ছেলে নয়। শান্তিপুর থেকে মামাবাড়িতে এসেছে তারপর আমাদের দলকে নানা গুণপনায় মুগ্ধ করেছে। তার গুণগুলির মধ্যে খেয়াল গান ছিল আমাদের ভীতির কারণ। সে ভোলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলল, তুই কোনো রাস্তা চিনিসনে। আমি আর যাচ্ছিনে, এখান থেকেই ফিরে চল্লুম। সে আরও জানাল, যে তার হাত-পা-শরীর সব কাঁপছে। তার পক্ষে আর চলা সম্ভব নয়। ভোলা বলল, তাহলে তো তোর পক্ষে ফেরাও সম্ভব নয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম, যে পথে এসেছি সে পথে বারবার যাওয়া যায় না। সামনেই এগুতে হবে। তবে তার আগে এই খোলা জায়গায় একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। অনেকেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। যে পথটি দিয়ে জয়ন্তীর উল্টোদিক থেকে আমরা মহাকালের গুহায় পৌঁছব ভেবেছিলাম, বুঝলাম মহাকালের গর্ভেই তা হারিয়েছে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, এমন একজন মানুষের দেখা মিলল না যার থেকে পথের সন্ধান পাওয়া যায়। জীবনপথেও তা যেমন দুষ্পাপ্য, এ পাহাড়ি জঙ্গলেও তাই।
বিস্কুট যা ছিল সঙ্গে, সেগুলি খেয়েই রওনা হলাম। এবার সাইকেল চালিয়ে। সাধনও গাঁইগুই করে পিছু নিয়েছে আমাদের। কিছুদূর গিয়েই এবার পথ ঢালু হয়ে এল। সাইকেলের প্যাডেলে আর চাপ দিতে হচ্ছে না। গড়গড়িয়ে নিজে থেকেই নেমে যাচ্ছে। গায়ে বাতাস লাগছে, নাকে বুনো গন্ধ। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম হয়তো। পথ ভেদ করে একটা বেশ বড় পাথর মাথা উঁচিয়েছিল, দেখতে পাইনি। যারা আমার অগ্রবর্তী, তারা পাশ কাটিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। আমার সাইকেলের সামনের চাকা পাথরে ধাক্কা মারল। আর আমি ছিটকে পড়লাম পাশের জঙ্গলে। মাথা আর কাঁধে আঘাত পেয়ে পড়ে রইলাম সেখানেই।
বন্ধুরা ছুটে এল। ভোলা আমাকে উঠে বসিয়ে বলল, কোথায় লেগেছে বল। এইসব আনাড়িকে আনতে নেই। বন্ধুদের উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু উদ্বিগ্নতম মুখ ছিল জলের বোতল হাতে আমার দাদার। দাদা ততক্ষণে অনেককিছু ভেবে নিয়েছে। কী করে আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, মা-বাবাকে কী ব্যাখ্যা দেবে ইত্যাদি। আমার মাথা ফাটেনি। ফুলে গেছে মাত্র। আমিও কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে ধীরে বুঝলাম তেমন কিছু হয়নি। একসময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম সমবেত হাততালির মধ্যে। এরপর এমন ঘন বন আমরা অতিক্রম করলাম যেখানে আলো প্রবেশ করেছে কম। সেখানে হাতির বিষ্ঠা দেখা গেল। টাটকা। সাধন বলল, আশেপাশেই তেনারা আছেন নাকি? ভোলা উত্তরে বলেছিল, আরে ওদেরও তো প্রাণে ভয় আছে, না কি?
আমরা আর কিছুদূর যাবার পর একটা আওয়াজ পেতে লাগলাম, যেন ভীমসেন যোশি গলা ছেড়েছেন। ভোলা বলল, সামনে নদী মনে হচ্ছে। এবং সত্যিই দেখি সামনে গমগমিয়ে বিবিধ আকার ও রঙের পাথরে বাধা পেতে পেতে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। ভোলা বলেদিল, জয়ন্তী নদী। অত বড় চওড়া নদীতে জল রয়েছে আধখানা নদী জুড়ে, বাকিটা সুদৃশ্য পাথর ছড়ানো ‘রিভার বেড’। মুখে কেউ বলিনি, কিন্তু সবাই বুঝেছিলাম, মহাকাল দিল্লির মতোই দূর অস্ত।
কিন্তু বিপদ এল অন্য দিক থেকে। বলা-কওয়া নেই হঠাৎ দুম করে অন্ধকার নেমে এল। পাহাড়ের সূর্যাস্তের এই নাকি রীতি। সকলেই বুঝলাম আমাদের এখানে, এই ‘রিভার বেড’-এই রাত কাটাতে হবে। এছাড়া অন্য কোনও উপায় দেখছি না। দ্রুত অন্ধকার নামছে। বিছিয়ে বসার মতো ত্রিপল ইত্যাদি কিছু সঙ্গে ছিল না আমাদের। চোখে পড়ল নদীর ধারে বেশ বড় বড় পাথর পড়ে রয়েছে। অনেক ক’টা। আমরা এক-একজন এক-একটা পাথর দখল করে বসলাম। দেখা গেল শোয়াও চলবে এখানে, আর পাথরের আড়ালে বেশ আগুন জ্বালানোও চলবে। আশ্রয় পেয়ে এবার আমাদের মনে পড়ল, বাড়িতে তো সবাই বলে এসেছিলাম, আজই ফিরব। সে নিয়ে অবশ্য কেউই বেশি উদ্বেগপ্রকাশ করল না। এইখানে বলে রাখি, বাড়ি ফেরার পর আমাদের কাউকেই বকাঝকার মুখে পড়তে হয়নি। আমার বাবা তো ছেলেদের অভিযানে বেশ গর্ববোধ করেছিলেন। সন্তানদের নিয়ে এরকম নিশ্চিন্ত থাকার অভ্যাস, আমরা বেশ কিছুকাল হল হারিয়ে ফেলেছি।
যাইহোক, পাথরগুলির দখল নেবার পর শুনলাম আমাদের আশু কর্তব্য, নদী থেকে জল সংগ্রহ করে আনা আর শুকনো কাঠপাতা জোগাড় করে আনা। টাবলুদার বাড়ি থেকে আনা হাঁড়ি করে জল সংগ্রহে গেল নিত্যানন্দ, জ্বালানি সংগ্রহে গেল ভোলা ও নিতাই। কর্ত্যব্যের ডাকে আমরা বাকিরা সাড়া দিই না। পথশ্রমের ক্লান্তিতে সকলেই প্রস্তরবৎ। পাথরের উপর শুয়ে বসে থাকি। দেখি তিনটি মোটামুটি বড় পাথর জোগাড় করে উনুন বানাচ্ছে ওরা। শুকনো পাতা ও ক্ষীণকায় ডাল উনুনে গুঁজে, দেশলাই জ্বেলে সমানে ফুঁ দিচ্ছে। একসময় শুনলাম উল্লাস। আগুন অবশেষে জ্বলেছে। আমাদের ভান্ডারে যে চা পাতা ও গুঁড়ো দুধ আছে, এটা আমার অন্তত জানা ছিল না। সবার কাছেই প্লাস্টিকের লাল নীল গ্লাস ছিল।গরম চা, চা বাগানের ছেলেদের গা গরম করে দিল।
এদিকে ভোলা, নিত্যানন্দ ও দাদা খিচুড়ি রান্নার তোড়জোর শুরু করে দিয়েছে। পাথরে শয়ান আমরা তাদের কাজের ত্রুটি ধরছি। শিলনোড়ার মতো আকারের এক শিলাখণ্ডে আলু কাটা চলছে। আলু ভাজাও হবে তাহলে। ভেবে খুশি হই। কিছুক্ষণ পরে খিদেপেটে খিচুড়ির সুবাসে আমরা উঠে বসলাম। এখনও দেরি আছে শুনে সাধন বলে, যা হয়েছে দিয়ে দে, আমি আর পারছিনে। আমি বললাম, খিচুড়ির গন্ধে হাতি না চলে আসে। এ পহাড়ে হাতির অভাব নেই। হাতির বিষ্ঠা পথে দেখেছি। বড় বাঘের কথা ইদানীং শোনা যায় না, তবে চিতা রয়েছে অনেক। নিরীহ পশুদের মধ্যে রয়েছে হরিণ, সজারু, ময়ূর ও নানা জাতের পাখি। ভোলা বলল, সারা রাত আগুন জ্বলবে। তাহলে আর কোনও ভয় নেই। বিশু ভোলাকে ভেঙিয়ে ফুট কাটল, ওদেরও প্রাণে ভয় আছে তো, নাকি?
সেদিন আকাশের সামিয়ানার তলে, চাঁদের আলোয় বসে, খিচুড়ি ও আলুভাজার যে স্বাদ পেয়েছিলাম, সেটা বর্নণাতীত। অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি আগুনের বৃত্ত তৈরি করে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম। তারপর দুজন করে জেগে রইলাম কাঠ ছুড়ে ছুড়ে আগুনটা জ্বালিয়ে রাখার জন্য। বেশি রাতে দেখলাম লক্ষ্মীপুজোর চাঁদ উঠেছে সদ্য পরিচিত পাহাড়ের মাথায়। চাঁদের আলোয় নদীর দু’দিকে পাহাড়ের শ্রেণি প্রাচীরের মতো ঘিরেছে জয়ন্তীকে। যতদূর চলেছে নদী দু’পাশ দিয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছে যেন অরন্যে ছাওয়া ভুটান পাহাড়, হিমালয়ের বংশধর সে। সারা রাত শুনলাম নদীর বিরামহীন চলার আওয়াজ। নদীর দুপাশের তীরে ঝরা ফুলের মত ফুটে আছে যেন রঙিন পাথরগুলি। নাকে জঙ্গলের গন্ধ আসে। রাতচরা পাখি উড়ে যায়, তাদের ডাক আকাশ চিরে ফেলে। আমাদের কণ্ঠস্বরগুলিও ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে।
ভোরের দিকটায় আমি আর নিতাই ডিউটি দিচ্ছিলাম। আমাদের এক অপূর্ব ভোর উপহার দিল ভুটানের আকাশ, পাহাড় আর অরণ্য। আকাশের এত রঙ আর অসামান্য রূপ আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিল। এমনকী গাছের পাতাগুলোও বারংবার এত রঙে ধরা দিল আমাদের চোখের সামনে, যে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। আলো ফুটতেই সবাই উঠে বসল। বাড়ি ফেরা প্রয়োজন এবার।
হঠাৎ দেখি, ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতো একজন মানুষ দুধের বড় পাত্র নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসছে। তার কাছে খবর পাওয়া গেল, জয়ন্তী নজ়দিকেই এবং সে জয়ন্তীতে দুধ পৌঁছতে যাচ্ছে। আমরা সাইকেল, বাসনপত্র তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গ নিলাম। সেই নজ়দিক জয়ন্তী পৌঁছতে আমাদের পাহাড়-নদী ডিঙিয়ে পাঁচঘণ্টা লেগেছিল। তবে কেউ যেন না ভাবেন, মহাকালের কৃপা আমরা পাইনি। পরের বছর আবার সেই লক্ষ্মীপূজোর দিনে আমরা মহাকালে পৌঁছেছিলাম। এবার আর রায়মাটাং দিয়ে নয়, জয়ন্তী হয়ে। কিন্তু সে অভিযান ভিন্ন। তার বর্ণনা এখানে বাদ থাক। শুধু বলি, সে অভিযানে বারংবার আমাদের উত্তাল জয়ন্তী নদী পার হতে হয়েছিল। সাইকেল রাখা ছিল জয়ন্তী বাজারে। রাত্রে মহাকাল গুহার বাইরে সেই একইরকম পাথরের আশ্রয় এবং সেখানে এক নিঃসঙ্গ সাধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ মনে থাকবে। সে রাত্রে খিচুড়ি রান্না করেছিলেন সাধুজি। সকালে দেখেছিলাম দলে দলে ধনেশ পাখি তাদের আজব ঠোঁট নিয়ে গাছে গাছে বসে রয়েছে।
আমাদের প্রথম অভিযানে আমার পতন ও প্রায় মূর্চ্ছা ব্যতীত অন্য আর একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সে কথা বলে এই অভিযান বর্ণনা শেষ করব। টাবলুদা যে হাঁড়িটা সঙ্গে এনেছিল, সেটা ফেরার পথে আবার পিঠে দড়ি দিয়ে বেধে পাহাড়ের পথ ভাঙছিল। একটা চড়াই উঠতে গিয়ে পিঠ থেকে খসে গিয়ে হাঁড়িটা ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে খাদের নীচে মিলিয়ে গেল। বোধ হয় জলেই গেল। হাঁড়ির শোকে ও বাড়িতে জবাবদিহির দুশ্চিন্তায় টাবলুদার সেই আর্তনাদ আর মাথায় হাত দিয়ে পথে বসে পড়ার দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে।
অপূর্ব দাশগুপ্ত: ‘পুরোগামী’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব কর্মকর্তা।
সূত্র: বাংলালাইভ.কম