Home চা শিল্প পানির পরেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় যে পানীয়টি

পানির পরেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় যে পানীয়টি

ছবি সংগৃহীত

সারা পৃথিবীর মানুষের খাদ্যতালিকায় যে পানীয়টি বহুকাল ধরে পানির পরেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে  জায়গা করে নিয়েছে তা হল চা (Tea)৷ চিন থেকে উৎপত্তি লাভ করে চা ধীরে ধীরে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে প্রথমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পর্তুগীজ বণিকদের হাত ধরে চা ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ব্রিটিশদের হাত ধরে তা সারা পৃথিবীতে একসময় ছড়িয়ে পড়ে।

চা আবিষ্কার প্রথম হয়েছিল চিনে এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই।  কিন্তু ঠিক কোন শতাব্দীতে এবং কে বা কারা পানীয় হিসেবে চায়ের প্রচলন শুরু করেছিল এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। প্রাচীনতম চীনা কবিতার সংকলন ‘শিজিগ’ (Shijig) -এ ‘তু’ নামের একটি শব্দ ব্যবহৃত হয় যার অর্থ – ‘তেতো গাছপালা’। যদিও এই তেতো গাছপালা বলতে অনেক ধরণের গাছপালার কথাই বোঝানো হতে পারে তবে ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই গাছপালার মধ্যে চা গাছ অবশ্যই  থাকবে।

অন্যদিকে চা আবিষ্কার নিয়ে লৌকিক কাহিনীও প্রচলিত আছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী ২৭৩৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এই পানীয়টি আবিষ্কার করেছিলেন চীনের সম্রাট শেননং। সম্রাটের একটি অভ্যেস ছিল জল খাওয়ার আগে তা ফুটিয়ে খেতেন। একবার দূরদেশে তাঁর সেনাবাহিনীসহ যাওয়ার পথে ক্লান্ত হয়ে তিনি একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে বসেন। পাশেই একটি পাত্রে তাঁর জন্য জল গরম করা হচ্ছিল। কাছাকাছি কোনও একটা গাছ থেকে হাওয়ায় উড়ে কিছু পাতা এসে ওই ফুটন্ত জলে পড়ে। তারপরই জলের রং বদলে গিয়ে বাদামি বর্ণ ধারণ করে। সেই উষ্ণ জল তিনি পান করে বেশ চনমনে বোধ করেন। সেই থেকে চায়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা চীনে। আর ধীরে ধীরে চীনের হাত ধরে সারা বিশ্ব চায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে৷

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে চীনের সঙ্গে চায়ের বাণিজ্যে সব থেকে বড় ক্রেতা ছিল ব্রিটিশরা। এই লেন-দেন চলত মূলত রুপোর কয়েনের মাধ্যমে৷ বলাবাহুল্য অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশদের  কোষাগারে বিপুল পরিমাণ রুপোর ঘাটতি দেখা যায়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ব্রিটিশরা ভারত থেকে চীনে আফিম রপ্তানি শুরু করে৷ ক্রমে ক্রমে চীনের যুবসমাজ আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে৷ এমন সংকটকালীন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ১৮৩৯ সালে চীনা শাসকেরা আফিম আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপরেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবৈধ উপায়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে । এই কারণে চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে দু -দফা যুদ্ধ হয় যা ইতিহাসে ‘আফিম যুদ্ধ’ (Opium War) নামে পরিচিত। শেষ পর্যন্ত চীনের চায়ের বাজারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের কর্তৃত্ব হারায়। এতেও না দমে গিয়ে চীনের কাছ থেকে চা চাষের কৌশল আয়ত্ত করার জন্য ব্রিটিশরা এবার রবার্ট ফরচুন নামে একজন স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে গোয়েন্দা হিসেবে চীনে পাঠায় চা চাষের কৌশল আয়ত্ত করার জন্য৷ তিনি সেখানে চা উৎপাদনের কৌশল পর্যবেক্ষণ করেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ চায়ের বীজ নিয়ে ফেরত আসেন। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ব্রিটিশ টি হেইস্ট’ নামে খ্যাত৷

ভারতবর্ষে চা কিন্তু এসেছিল আরও অনেক আগে৷ ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে আসামের কাছার জেলার সুপারিনটেন্ডেন্ট চা কমিটির সচিব জিটি গর্ডনকে কাছারে চা চাষের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে চিঠি লেখেন। এরপর ১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডের তিনটি ও কলকাতার একটি কোম্পানি চা চাষ করার অনুমতি চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করে। এই কোম্পানিগুলোকে পরে একসাথে  করে ‘আসাম কোম্পানি’ নামের একটি কোম্পানি গঠিত হয়। চা চাষের জন্য আদর্শ মাটি ও যে মনোরম আবহাওয়ার প্রয়োজন তার ভিত্তিতে আসাম, সিলেট, কাছার, ডুয়ার্স ও দার্জিলিংয়ে চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করা হয়।

প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস গাছ থেকে উৎপাদিত হয়। গাছ থেকে চা পাতা তোলবার পর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হল অক্সিডেশন বা জারণ প্রক্রিয়া। অক্সিডেশন হল কোন খাদ্য বস্তুর দ্বারা অক্সিজেনের শোষণ।      চায়ের প্রস্তুতকরণের ওপর ভিত্তি করে চা মূলত ছয় প্রকার –

১. গ্রিন টি – ছয় প্রকার চায়ের মধ্যে গ্রিন টি হল একমাত্র চা যাকে জারিত না করেই প্রস্তুত করা হয়। এই পদ্ধতিতে চায়ের পাতা প্রথমে কড়ায় হালকা করে গরম করা হয় এবং তারপর শুকনো করা হয়। চিন এবং জাপানে প্রায় হাজার বছর ধরে এই চা রোগ প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই চায়ে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে যার ফলে স্বাস্থ্যের পক্ষে এই চা অত্যন্ত উপকারী।

২. ব্ল্যাক টি – ছয় রকম চায়ের মধ্যে এই ব্ল্যাক টিকেই  সবচেয়ে বেশি জারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অত্যধিক জারিত হওয়ার ফলে এই চা কালো রঙের হয়। এই চা খুব কড়া স্বাদের হয়।  মূলত দুধ চিনি সহযোগে এই চা পান করা হয়।

৩. ওলং টি – এই চায়ের উৎপত্তিও চীনে।  মূলত গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টি দুইয়ের বৈশিষ্ট্য নিয়েই এই ওলং চা তৈরী হয়।  এই চা প্রস্তুতকরণের সময় ব্ল্যাক টির মত একে অতিরিক্ত জারিত করা হয় না।  ফলত চা পাতার রং হালকা সবুজ রঙা হয়।  চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে এই চা অত্যন্ত জনপ্রিয়।

৪. হোয়াইট টি – চা সমঝদারদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় চা হল এই হোয়াইট টি বা সাদা চা।  গাছ থেকে পাতা তোলবার পর সবথেকে কম প্রক্রিয়াকরণ করা হয় এই চা পাতার। পূর্ণাঙ্গ পাতা হওয়ার আগেই কুঁড়ি অবস্থাতেই এই চায়ের পাতা গাছ থেকে তুলে নেওয়া হয়।  স্বাদে ও গন্ধ উভয় ক্ষেত্রেই এই চা মৃদু প্রকৃতির।

৫. পুয়ের টি – চিন থেকে আগত এই চায়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল এর মাটি মাটি গন্ধ।  ব্ল্যাক টির মত কালো রঙের হয় এবং এতে ক্যাফিনের পরিমাণও ব্ল্যাকটির মতোই বেশ বেশি। এই চায়ের স্বাদ বেশ চড়া হয়।  চা বাগানের বদলে জঙ্গলে জন্মানো চা গাছ থেকে এই চায়ের পাতা সংগ্রহ করা হয়।

৬. মাচা টি – এটি একধরণের গুঁড়ো চা যা জাপানে বিশেষ জনপ্রিয়। গ্রিন টি প্রস্তুতের জন্য নির্ধারিত চা পাতাকে গুঁড়ো করে এই চা তৈরী হয়। জাপানের ঐতিহ্যশালী চায়ের অনুষ্ঠান এই মাচা চাকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়।

চায়ের সেভাবে কোন পুষ্টিগুণ নেই। ক্যাফিন থাকার কারণে চা ঘুম প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয় চায়ে আদৌ কোন পুষ্টিগুণ নেই। তবে ব্ল্যাক টি এবং গ্রিনটিতে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান থাকে।

শরৎচন্দ্র দাস রচিত ‘ইন্ডিয়ানস পণ্ডিতস ইন দ্য ল্যান্ড অব স্নো’ (১৮৯৩) গ্রন্থে  ১০৪২ সালে অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত ভ্রমণে গিয়ে চা পানের উল্লেখ আছে।  বিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই বাংলায় চায়ের অভ্যাস দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাঙালি জীবনে চায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।  যেকোন অতিথি আপ্যায়নে বা পথের ক্লান্তি দূর করতে চা বাঙালির সবথেকে জনপ্রিয় সমাধান। সারা বাংলার প্রতিটি পাড়া থেকে রাজপথে যে দোকানটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা চায়ের দোকান।  এক ভাঁড় চা খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা বাঙালি জীবনের একটি অত্যন্ত পরিচিত ছবি।

চা যেখানে পানির পর দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয় সেখানে সাহিত্যে চায়ের প্রভাব পড়বে একথা বলাই বাহুল্য। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চা নিয়ে অসাধারণ একটি কবিতা আছে যার খবর অনেক চা মোদী বাঙালিরই জানা নেই। কবিতাটির নাম – ‘চায়ের পিয়াসি পিপাসিত চিত আমরা চাতক-দল।’ কবিতাটিতে তিনি লিখছেন –

“চায়ের পিয়াসি পিপাসিত চিত আমরা চাতক-দল।
দেবতারা কন সোমরস যারে সে এই গরম জল।
চায়ের প্রসাদে চার্বাক ঋষি বাক-রণে হল পাশ,
চা নাহি পেয়ে চার-পেয়ে জীব চর্বণ করে ঘাস।
লাখ কাপ চা খাইয়া চালাক
হয়, সে প্রমাণ চাও কত লাখ?
মাতালের দাদা আমরা চাতাল, বাচাল বলিস বল॥
চায়ের নামে যে সাড়া নাহি দেয় চাষাড়ে তাহারে কও,
চায়ে যে ‘কু’ বলে চাকু দিয়ে তার নাসিকা কাটিয়া লও।”

চায়ের প্রতি এই প্রেম কেবল বিদ্রোহী কবিরই ছিল না, স্বয়ং বিশ্বকবিও চায়ের প্রেমে মশগুল ছিলেন। তৎকালীন সময়ের কলকাতার নামী চা ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাজি হাশিম, মতিলাল শীলদের সাথে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথের নামও উচ্চারিত হত।  পারিবারিক ভৃত্য বনমালীর হাতের চা না এলে কবিগুরুর ঘুম ভাঙতো না।  চায়ের প্রতি নিজের প্রেম বোঝাতে চাকে উদ্দেশ্য করে একটি গানও লিখেছিলেন যা তাঁর ‘বিচিত্র’ নামক গীতিসংকলনের একশো তেইশ নং কবিতা হিসেবে সংকলিত আছে –

“হায় হায় হায়       দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল  চাতকদল চল’   চল’ চল’ হে॥
টগ’বগ’-উচ্ছল   কাথলিতল-জল   কল’কল’হে।
এল চীনগগন হতে  পূর্বপবনস্রোতে  শ্যামলরসধরপুঞ্জ॥
শ্রাবণবাসরে  রস ঝর’ঝর’ ঝরে,  ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ  দলবল হে।
এস’ পুঁথিপরিচারক  তদ্ধিতকারক  তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস’ গণিতধুরন্ধর  কাব্যপুরন্দর   ভূবিবরণভাণ্ডারী।”

এছাড়াও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর  ‘মড়িঘাটের মেলা’ গল্পে হাটে চা বিক্রির বর্ণনা দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘একটি জীবন’ গল্পেও ক্ষিদে মেরে দেওয়ার উপায় হিসেবে চাকে দেখানো হয়েছে।

চায়ের জন্য যুদ্ধ থেকে চায়ের বাক্স সমুদ্রে ফেলে প্রতিবাদ, ইতিহাস সাক্ষী আছে এই একটি মাত্র পানীয়ের আপামর পৃথিবীর মানুষকে কীভাবে যুগ যুগ ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।  বাঙালি জীবনও সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি বলাই বাহুল্য।  সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা কিংবা সন্ধ্যের আড্ডায় চায়ের টেবিলে তুফান তুলে বিশ্ব রাজনীতির পর্যালোচনা বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চাপ্রেমী হিসেবে অবশ্য কেবল বাঙালির কথা বললে ভুল হবে, সারা ভারত জুড়েই চায়ের দাপটের কাছে কোন পানীয়ই টিকতে পারেনি এখনো।

-সংগৃহীত