বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
চাঁদের মাটি ছেড়ে পৃথিবীর পথে রওনা হয়েছে চীনা চন্দ্রযান চ্যাং’ই- ফাইভ। সঙ্গে নিয়ে আসছে নুড়ি ও বালির নমুনা। বৃহস্পতিবার চন্দ্র পৃষ্ট ছেড়ে কক্ষপথে মূল যানে যোগ দেয় অ্যাসেন্ডার।
গত মঙ্গলবার চ্যাং’ই- ফাইভের ল্যান্ডার চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে। এর পরপরই পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য সেটি পাথর ও মাটির নমুনা সংগ্রহ শুরু করে।
এসব নমুনা প্রথমে পাঠানো হয় চাঁদকে প্রদক্ষিণকারী একটি মহাকাশযানে। যানটি সেগুলো নিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসবে। বৃহস্পতিবার সেই কাজ শুরু হয়েছে।
চীন গত সাত বছরে তিনবার চাঁদে চ্যাং’ই মহাকাশযান পাঠিয়েছে। এর আগে চ্যাং’ই- থ্রি এবং চ্যাং’ই- ফোর চাঁদে স্ট্যাটিক ল্যান্ডার ও ছোট রোভার নামায়। তবে সর্বশেষ অভিযানটি আগের দুটোর তুলনায় অনেক বেশি জটিল।
এক সপ্তাহের কিছু আগে ৮.২ টন ওজনের চীনা রকেটটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। এরপর মাল্টি মডিউল প্রোবটি চাঁদের কক্ষ পথে ঘুরতে থাকে। এরপর সেটা দু’ভাগে ভাগ হয়। একটি ভাগে ছিল একটি ল্যান্ডার এবং আরেকটি অ্যাসেন্ডার রকেট। সেটি চাঁদের অবতরণ করে।
নমুনা সংগ্রহ শেষ হলে অ্যাসেন্ডারের মাধ্যমে চাঁদ প্রদক্ষিণকারী রকেটে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর শুরু হয় পৃথিবীতে ফিরে আসার মিশন।
চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে শেষবারের মতো পাথর ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল ৪৪ বছর আগে। আমেরিকান অ্যাপোলো মিশনের নভোচারীরা এবং সোভিয়েত আমলের রোবটিক ল্যান্ডার প্রায় ৪০০ কেজি নমুনা নিয়ে এসেছিলেন।
এসব নমুনা ছিল খুবই প্রাচীন, প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগের। তবে চ্যাং’ই- ফাইভ যেসব নমুনা আনবে সেগুলো একেবারেই ভিন্ন। ১২০ থেকে ১৩০ কোটি বছর পুরোনো।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এ মিশনে সংগ্রহ করা দুই কিলোগ্রাম নমুনা চাঁদের সৃষ্টি, গঠন ও সেখানে আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।
অভিযানটি পরিচালিত হয় ওসেনাস প্রসেলারারাম নামে পরিচিত একটি নিকটবর্তী অঞ্চলে, যেখানে রয়েছে আগ্নেয়গিরির লাভার জটিল বিন্যাসে গঠিত মনস রামেকার।
নিকটবর্তী অঞ্চল বলতে চাঁদের যে মুখটি পৃথিবী থেকে দেখা যায়, তাকে বোঝানো হয়। এর আগে উল্টোদিকের দূরবর্তী অঞ্চলে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি যান পাঠায় এশিয়ার দেশটি।
সপ্তাহ দেড়েক চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাইনান প্রদেশ থেকে চ্যাং’ই-ফাইভ চন্দ্রযানটিকে একটি রকেটে করে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১১২ ঘণ্টার মহাকাশ সফর শেষে চন্দ্রযানটি ২৮ নভেম্বর চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। আর মঙ্গলবার চাঁদের নিকট প্রান্তে অবতরণ করে।
চ্যাং’ই- ফাইভের সংগ্রহ করা নমুনা একটি ক্যাপসুলে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, যা অবতরণ করবে উত্তর চীনের মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে।
চিনের মহাকাশবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই চন্দ্রাভিযান সফল হলে চার দশকের মধ্যে এই প্রথম কোনও মহাকাশচারী ছাড়া শুধু যন্ত্রের মাধ্যমেই চাঁদের মাটি থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজে সফল হবে চিন।
চিনের জাতীয় সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুর তিনটে দশে চিনের ওয়েনচ্যাং স্পেস লঞ্চ সেন্টার থেকে সফলভাবে উড়ে যায় চন্দ্রযানটি। চিনের চন্দ্রদেবতার নামানুসারে এই যানটির নাম রাখা হয়েছে চ্যাং’ই-৫।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই মহাকাশযানকে বর্তমানে পৃথিবী থেকেই রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন চিনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। এর পরে একটি যন্ত্র চাঁদের মাটি খুঁড়বে। আর অন্য যন্ত্রটি সেই খোঁড়া অংশ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করবে। এর পরে কক্ষপথে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রযান মারফত সেই নমুনা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেবে তারা। চিনের মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে সেই নমুনা নিয়ে চলবে আরও গবেষণা।
সেই সত্তর দশকে রাশিয়া অর্থাৎ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরপর বেশ কয়েকটি মহাকাশযানে নভোশ্চারীদের পাঠিয়েছিল চাঁদে। তথ্য বলছে, সেই মহাকাশযানগুলি চাঁদের মাটি থেকে অন্তত ৩৮২ কেজি নুড়ি-বালি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছিল। তবে চিন কিন্তু রাশিয়ার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে চন্দ্র অভিযানের ব্যাপারে। এবার সেই ইতিহাসেই নতুন করে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে চায় চিন। সেই উদ্দেশেই বেজিং এই চন্দ্রাভিযানের আয়োজন করেছে।
পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ নিয়ে গবেষণা চলছে সেই কত বছর ধরে। চাঁদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য কী, তার প্রকৃত চেহারাই বা কেমন, কীভাবে জন্ম এ উপগ্রহের, তার মাটির নীচে কোন কোন সম্পদ লুকিয়ে, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই মহাকাশবিজ্ঞানীদের। এবার সে জন্যই চাঁদ নিয়ে গবেষণায় জোর দিয়েছে জিনপিং সরকার। তারই ফল আসন্ন চ্যাং’ই-৫ অভিযান। সব ঠিক থাকলে, চাঁদের যে এলাকা ঝঞ্ঝাপ্রবণ সেই ‘ওশিয়ান অফ স্টর্মস’ থেকে দু’কেজি নমুনা সংগ্রহ করবে এই চন্দ্রযানটি।
তবে এটি কেবলই শুরু। এর পরে চন্দ্র গবেষণায় আরও বড় পরিকল্পনা আছে চিনের। আগামী ১০ বছরের মধ্যে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অর্থাৎ যেদিকটা প্রায় অন্ধাকার, সেদিকে বেশ কয়েকটি রোবোটিক বেস স্টেশন তৈরি করা হবে চিনের তরফে। এর ফলে ২০৩০-এর মধ্যে চাঁদে চিনের মহাকাশচারী পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়ে যাবে।
আপাতত এই অভিযান সফল হওয়াটা বেজিংয়ের কাছে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই একটা বিষয়, এমনটাই জানিয়েছে চিনা সংবাদমাধ্যম শিনহুয়া। কূটনৈতিক মহলের মতে, বর্তমানে করোনা ভাইরাসকে ঘিরে যেভাবে আন্তর্জাতিক মহলে কোণঠাসা হয়েছে চিন, চন্দ্রযানের এই সাফল্য চিনকে সেই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে।