চৈতালী চক্রবর্তী
পিং নদীর কোলে সূর্য অস্ত যায়। গোধুলির নরম আলো তেরছা হয়ে পড়ে সুপ্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের চূড়ায়। বিদায়ী সূর্যের আলোর সঙ্গে মিলিয়ে লাল-কমলা আভা খেলা করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের শান্ত-প্রশান্ত মুখের উপর। সময় থমকে যায় এখানে। প্রকৃতির এমন কোমল নিস্তব্ধতা ভাঙতে চায় না পাখিরাও। নিশ্চুপে তারা ঘরের পথ ধরে। পশ্চিম আকাশে রঙ যখন আর একটু গাঢ় হয়, গুরুগম্ভীর স্বরে প্রার্থনার ধ্বনি শোনা যায় ‘ওম্ মণিপদ্মে হুম্!’
উত্তর থাইল্যান্ডের বৃহত্তম শহর। চিয়াং মাই প্রদেশের রাজধানী। অবস্থানটা আরও একটু স্পষ্ট করে বললে ব্যাঙ্কক থেকে ৭০০ কিলোমিটার উত্তরে। থাইল্যান্ডের সুউচ্চ পর্বতমালা ডোয়ে ইনথাননের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চিয়েং মাই বা চিয়াং মাই। থাই ভাষায় এই চিয়াং মাই-এর অর্থ হল ‘নতুন শহর’ । বয়সে নয়, বিবর্তনে।
আজকাল আম বাঙালিরাও ছুটি কাটাতে ব্যাঙ্ককে যেতে স্বচ্ছন্দ। যদি ব্যাঙ্ককই ডেস্টিনেশন নয় তাহলে সেখান থেকে থাই এয়ারওয়েজের বিমানে ঘণ্টা তিনেকের পথ চিয়াং মাই। বাস বা ট্রেনেও ব্যাঙ্কক থেকে যাওয়া যায়। এ শহর না দেখলে থাইল্যান্ডের মূল ভাবধারাই অধরা থেকে যায়। চিয়াই মাইকে এক কথায় বর্ণনা করতে হলে থাইরা বলবেন ‘M.E.A.T’ অর্থাৎ বাজার, হাতি, স্থাপত্যকলা এবং টেম্পল বা মন্দির। সব নিয়েই এ শহর বেশ আছে।
বৌদ্ধ মন্দির, তাদের ভাস্কর্য চিয়াং মাইকে পরিচিতি দিয়েছে। পুরনো শহরকে খুঁজে পেতে হলে ওয়াত ফ্রা সিং বা ওয়াত চেদি লুয়াং যেতেই হবে। চোদ্দ শতকে রাজা সায়েন মুয়াং মা এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। ওয়াত চেদি লুয়াং মন্দিরটি তিনটি মন্দিদের সমন্বয়ে তৈরি। ওয়াত চেদি লুয়াং, ওয়াত হো থাম ও ওয়াত সুকমিন। ওয়াত ফ্রা সিং মন্দিরে মতো এই মন্দিরটিও ওল্ড সিটিতেই পড়ে। সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ মন্দির হল ওয়াত চিয়াং মান। পিং নদীর কাছ ঘেঁষে এই মন্দির চিয়াং মাইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চিয়াং মাই শহর তৈরি হয় ১২৯৬ সালে। তার পরের বছরই অর্থাৎ ১২৯৭-এ গড়ে ওঠে ওয়াত চিয়াং মান। সেই রাজা মাঙ্গরাইয়ের সময় প্রাচীন উইয়্যাং নোপবুরি এলাকায়। একসময় লাওয়া ভাষীদের শহর ছিল এই নোপবুরি।
চিয়াং মাইয়ের লান্না সাম্রাজ্যের ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়াত চেদি লিয়াম বৌদ্ধ মন্দির। এখানকার স্থাপত্য মনে তুলে রাখার মতো। চিয়াং মাই এলে ওয়াত সুয়ান ডকে যেতেই হয় একবার। লান না থাই রাজার প্রমোদ উদ্যান হিসেবে তৈরি হয়েছিল একসময়।
পুরনো শহরেই প্রকৃতির কোলে বসে আছে আরও এক বৌদ্ধ মন্দির ওয়াত উমং। বয়স ৭০০ বছরের কম হবে না কিছুতেই। জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয় এই মন্দিরে। স্থানীয়রা বলেন ‘ফরেস্ট টেম্পল’ । ডোয়ে সুথেপ পাহাড়ের বিপরীতে এই মন্দির পড়ে। চিয়াং মাই ইউনিভার্সিটি থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে। এই মন্দির তৈরি হয়েছিল ১২৯৭ সালে। লান না সাম্রাজ্যের শাসনকালে। বহুকাল ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা বৌদ্ধ মন্দিরে নিশ্চিন্ত সাধনায় লীন হয়ে আছেন। মন্দির লাগোয়া ছোট চিড়িয়াখানাও আছে। এখানে বৌদ্ধ পুণ্যার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে।
প্রকৃতির কাছাকাছি আরও একটু থাকার স্বাদ হলে এলিফ্যান্ট নেচার পার্ক ঘুরে আসাই যায়। চিয়াং মাই থেকে ৪০ কিলোমিটারের পথ। ২০০ একর এলাকা জুড়ে জাতীয় উদ্যান। ১৯৯০ সাল থেকেই এখানে পর্যটকদের আনাগোনা। ঝটতি সফর না চাইলে জাতীয় উদ্যান লাগোয়া কেরান গ্রামে হোম স্টে থেকে কয়েকদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। বন্যপ্রাণ আর সবুজের গন্ধে মন তাজা হবে।
ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সাহিত্যের আকর্ষণ থাকলে থাপায়ে ইস্ট অপেক্ষা করছে। নিরিবিলিতে বইয়ের পাতায় ঘণ্টাখানেক ডুবে থাকা যায়। সময়ে সময়ে ছোটখাটো অনুষ্ঠানও লেগেই থাকে এখানে। সাহিত্যপ্রেমীদের পছন্দের জায়গা। নানারকম ভাস্কর্য, চিত্রকলার সৌন্দর্য দেখতে হলে বান কাং ওয়াতের গ্যালারি কাং ওয়াত, হার্ন গ্যালারি রয়েছে। ছোটখাটো ক্রাফ্ট গ্যালারিও চোখে পড়বে।
ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁয় সময় কাটাতে হলে জিনজার অ্যান্ড কাফে অতুলনীয়। নিভু নিভু আলোয় পর্ক রিব লাল জবজবে কারিতে ডুবিয়ে বা ডাক ব্রেস্টে মজে গিয়ে রোম্যান্স বেশ জমে উঠবে। তবে পর্যটকরা চিয়াং মাইয়ের খোলামেলা বাজার আর স্ট্রিট ফুড বেশ পছন্দ করেন। চাং খালাড রোডে প্রতি সন্ধ্যায় যে পুজোর বাজারের ভিড় লেগে থাকে। কেনাকাটার সঙ্গে চলে পেটপুজো। প্রল ফর গাই ইয়াং অর্থাৎ গ্রিলড চিকেন, খাও খা মো মানে পর্কের আইটেম, কানোম জিন-ঝোলে চোবানো রাইস নুডলস হাপুস হুপুস করে খেতে খেতেই চিয়াং মাইয়ের সান্ধ্য বাসর জমে ওঠে।
শনিবার, রবিবার করে ইউলাই রোডে হ্যান্ডিক্রাফ্ট বা রূপোর গয়না কেনার লম্বা লাইন পড়ে যায়। মুন মাং রোডের সোমফেট বাজারও পর্যটকদের বেশ আকর্ষণের জায়গা। কেনাকেটার শেষ হলে সময় করে সান কামফানেগে চট করে ঘুরে আসা যায়। শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে একটি উষ্ণ প্রস্রবন। অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য গা ডুবিয়ে শহুরে কোলাহল থেকে নিষ্কৃতি মেলে।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা চিয়াং মাই ভ্রমণের জন্য আদর্শ নয়। এই সময় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চাষীরা শুকনো ফসল, ডালপালা, আবর্জনা পোড়ায়। বাতাসে দূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এই সময়টা বাদ দিয়ে জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারিতে চিয়াং মাই ঘোরার আদর্শ সময়। এই সময় ফুল উৎসব হয় শহরে। বিরাট বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার সঙ্গে প্যারেড। নানারকম পোশাক, বিচিত্র সংস্কৃতির সম্ভার।
এখানকার বিখ্যাত উৎসব হল লোই ক্রাথোং। থাই লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। কলাপাতা দিয়ে তৈরি কন্টেনার বা ক্রাথোং-এ করে ফুল নিয়ে এসে দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়। লান্না সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য মেনে ফানুস ওড়ানো হয়। জলের দেবতার কাছে সুখ ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা করেন চিয়াং মাইয়ের বাসিন্দারা।
শুধু ঘুরব বলেই ঘোরা নয়, একটা শহরের ইতিহাস, তার রূপ, রস, গন্ধ মনে মেখে নিতে হলে চিয়াং মাই হোক আপনার আগামী ডেস্টিনেশন।