Home Second Lead চেম্বার অব কমার্সের ভোটার ইজিবাইক চালক, দোকান কর্মচারি, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান

চেম্বার অব কমার্সের ভোটার ইজিবাইক চালক, দোকান কর্মচারি, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান

  • জাল আয়কর সনদে ভোটার
  • নিজেও জানেন না কিভাবে ভোটার
  • হাসান ট্রেডার্সের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগের জন্য কোনো মোবাইল ফোন নম্বর নেই। তবে, তার দেয়া আয়করপত্রটি যাচাই বাছাই করে দেখা যায় জাল।

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

যশোর: শেখহাটির আসাদুজ্জামান লালন। পেশায় ইজিবাইক চালক। জাল আয়কর সনদ দিয়ে তাকে যশোর চেম্বার অব কমার্সের ভোটার করা হয়েছে। তার ভোটার নম্বর ৯৭৩। অন্য এক প্রতিষ্ঠান আর এন রোডের আনছারী ট্রেডার্স। ১০ বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে। মালিক ইমাম হাসান দেউলিয়া হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। তাকেও জাল আয়কর সনদ দিয়ে ভোটার করা হয়েছে। তার ভোটার নম্বর ৯২৫।

যশোর চেম্বার অব কমার্স নির্বাচনে এরকম অসংখ্য ভুয়া ভোটারের সন্ধান পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। আদালত কর্তৃক ভোট স্থগিত হওয়ার পর যশোরে সরস আলোচনায় রূপ নেয় ভুয়া ভোটারের নির্বাচনী কুট কৌশল। ভোটে জিততে এরকম তিনশ’ ভুয়া ভোটার বানানো হয়েছে বলে কথা ওঠে। এর জের ধরে এই অনুসন্ধান। সত্যতা মেলে আলোচনার। দুটি প্যানেলের পক্ষেই রয়েছে ভুয়া ভোটারের ছড়াছড়ি। কিছু ভোটারের বক্তব্য আবার হতবাক করার মতো।

শহরতলীর বিরামপুর গাবতলার আব্দুর রহিম। তার কোনো ব্যবসাই নেই। পরের দোকানে চাকরি করেন। তিনিও হয়েছেন ভোটার। একই এলাকার সরোয়ার হোসেন ক্ষুদ্র মুদি ব্যবসায়ী। কিন্তু নিজেও জানেন না জাল আয়কর সনদ প্রদান করে কীভাবে চেম্বার অব কমার্সের ভোটার হয়েছেন! শুধু তাই না, এ কারণে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও হয়েছে। লালন, হাসান, রহিম কিংবা সরোয়ার না। এ ধরনের অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন যারা অবৈধভাবে হয়েছেন যশোর চেম্বারের ভোটার। যাদের নেই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেকেই আবার ভবঘুরে।  কয়েকদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।  কোনো যাচাই বাছাই না হওয়ায় যারাই আবেদন করেছেন তাদের সকলেই ভোটার হয়েছেন। আর এ অনৈতিক কাজের সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে দু’ গ্রুপের প্রার্থীদেরই। যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এই হ য ব র ল অবস্থার নিরসন চান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার। আর তার পরই দ্রুত নির্বাচন গ্রহণের দাবি তাদের।

যশোর চেম্বারে জমা দেয়া আসাদুজ্জামান লালনের মালিকানাধীন শেখহাটির হাইকোর্ট মোড়ের সৌদি অটোসের সন্ধানে গিয়ে সেখানে কোথাও সৌদি অটোসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে ভোটার তালিকা থেকে মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে কল করা হয় লালনকে। ও পাশ থেকে জানান তিনি ইজিবাইক চালাচ্ছেন। দেখা করার কথা বললে বাবলাতলায় যেতে বলেন। বাবলাতলায় গিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি চেম্বার অব কমার্সের সদস্য কিনা জানতে চাইলে বিব্রতবোধ করেন। প্রথমে অস্বীকার করলেও একপর্যায়ে স্বীকার করেন তার সৌদি অটোস নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ভুয়া আয়কর সনদ দিয়ে আরএন রোডের এক ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় তিনি এ কাজ করেছেন।

ভোটার তালিকায় থাকা ৯৭০ নম্বর ভোটার হাসান ট্রেডার্সের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগের জন্য কোনো মোবাইল ফোন নম্বর নেই। তবে, তার দেয়া আয়করপত্রটি যাচাই বাছাই করে দেখা যায় জাল।

বিরামপুরের গাবতলায় রহিম স্টোরের খোঁজ মেলেনি । কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। না পেয়ে মালিক রহিমের মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি জানান, ঝুমঝুমপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভবিষ্যতে তিনি বিরামপুরে দোকান দিবেন! তাই আগে থেকেই চেম্বারের সদস্য হয়েছেন। নিজে জাল আয়কর দিয়ে সদস্য হয়েছেন বলে স্বীকার করেন। পরে জানা যায়, তিনি এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক প্রার্থীর কর্মচারী। ওই প্রার্থীর ইন্ধনেই তিনি এই কাজ করেছেন।

বিরামপুর কালীতলার সরোয়ার হোসেন। তার কাছে গিয়ে দেখা যায়, তার ছোট একটি মুদি দোকান রয়েছে। পাশেই রয়েছে ক্যারাম বোর্ডের ঘর। তিনি নিজেও জানেন না কীভাবে চেম্বার অব কমার্সের ভোটার হয়েছেন। শুধু তাই না, জাল আয়কর সনদ দিয়ে ভোটার হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। যা নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি ছোট ব্যবসায়ী। দিন আনি দিন খাই। চেম্বারের সদস্য হওয়া তার জন্য না। তিনি ধারণা করেন শীর্ষ এক নেতার সাথে তার মেলামেশা রয়েছে। তার ধারণা ওই নেতাই তাকে ভোটার করেছেন। একই এলাকার আরেক ভোটার ও দায়ের করা মামলার বিবাদী বিরামপুর গাবতলার আলম ট্রেডাসের মালিক মো.আলমের দোকান খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকেও জাল আয়কর সনদ দিয়ে ভোটার করা হয়েছে ইঙ্গিত করে এ বিষয়ে কথা বলতে বিব্রতবোধ করেন। একপর্যায়ে জাল আয়কর সনদের কথা বললে তিনি লাইন কেটে দেন। এছাড়া, দু’দিন ধরে খুঁজে সন্ধান পাওয়া যায়নি আরএন রোডের আনছার ট্রেডার্সের। একপর্যায়ে মালিক হাসানকে কল করলে তিনি জানান, ১০ বছর আগেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি আর ব্যবসা করেন না। কীভাবে জাল সনদ দিয়ে ভোটার হয়েছেন তার সদুত্তর দেননি। তবে, ইঙ্গিত দিয়েছেন আরএন রোডের প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী এবং এই নির্বাচনের এক প্রার্থীর মাধ্যমে তিনি ভোটার হয়েছেন।  অনুসন্ধানে আরও অসংখ্য জাল সনদে ভোটার হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

শুধু জাল আয়কর সনদ দিয়ে ভোটার হয়েছেন এমনটিই না, অনেকেই ২০১৬ সালের আয়কর সনদ দিয়েও হয়েছেন ভোটার। তাদের একজন বেজপাড়ার ক্রাউন এন্টারপ্রাইজের মালিক নাজমুস সাকিব। বেজপাড়ায় ক্রাউন এন্টারপ্রাইজ নামে তার একসময় প্রতিষ্ঠান ছিল। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ, তিনি ২০১৬ সালে আয়করের টাকা জমা দেন। এবং সেই সনদই তিনি জমা দিয়েছেন। তাতেও তিনি হয়েছেন চেম্বার অব কমার্সের ভোটার। অথচ নিয়ম রয়েছে ২০২২-২০২৩ সালের আয়কর প্রদানের কপি জমা দিয়ে সদস্য হতে হবে। যা নিশ্চিত করেন নাজমুস সাকিব নিজেই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি বর্তমানে ঢাকায়। চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ছিলেন। ফলে সেই আগের কাগজ দিয়েই তিনি সদস্য হয়েছেন। তিনি জাল কোনো সনদ দেননি।
কয়েকদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, চেম্বারের নির্বাচনে ভোটার তালিকা তৈরীর ক্ষেত্রে কোনো যাচাই বাছাই হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে চেম্বারে নির্বাহী কমিটি না থাকা। চেম্বারের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে দু’ প্যানেলের প্রার্থীরাই নিজেদের পছন্দের ব্যবসায়ীদের ভোটার করেছেন। প্রার্থীদের অনেকেই নিজেদের টাকা দিয়ে তাদের ভোটার করেছেন। পরে তা নির্বাচনী বোর্ডের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এবং তা অনুমোদন করা হয়েছে।
সহকারী নির্বাহী অফিসার মুরাদ আলী বলেন, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সদস্য পদ নবায়ন করা হয়। সদস্যরা ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদের কপি দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন করেন। এসময় পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩ জন আবেদন করেন। তাদের সবাইকে সদস্যপদ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া ব্যবসায়ী অধিকার পরিষদের নেতা হুমায়ুন কবীর কবু বলেন, তাদের একটাই দাবি নির্বাচন। তবে, অবশ্যই জাল ভোটারদের বাদ দিতে হবে। তাদের প্যানেলে ভুয়া ভোটার তৈরির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের নেতা মিজানুর রহমান খান বলেন, জাল ভোটার যদি থেকেই থাকে তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কেন জানানো হলো না। এটি পরিকল্পিত বলে তার দাবি। তিনিও দাবি করেন, জাল ভোটারের নির্বাচন তাদের কাম্য না। তবে, দ্রুতই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া তাদের দাবি। তিনিও জাল ভোটার তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে চেম্বার অব কমার্সের প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রফিকুল হাসান বলেন, তারা যতটুকু সম্ভব সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করেছেন। তারপরেও কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তবে এসব ভোটারকে যাচাই বাছাই শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, নির্বাচনী বোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী, বর্তমানে যশোর চেম্বার অব কমার্সে ২ হাজার ৪৩ জন ভোটার রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাধারণ সদস্য রয়েছেন ১ হাজার ৩১জন, সহযোগী সদস্য ১ হাজার ১০ জন ও গ্রুপ শ্রেণির ভোটার রয়েছেন দু’জন। কিন্তু বাস্তবে কতজন বৈধ ভোটার আর কতজন অবৈধ ভোটার তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।