রবিবার পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা ছিল সংসদে। কিন্তু তা শুরু হওয়ার আগেই বাতিল হল পাক সংসদে। ইমরান খান আগেই বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব! কিন্তু এভাবে যে লড়াইয়ের মোড় ঘুরে যাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি।
রবিবার ঘটনাবলির রঙ এত দ্রুত বদলাতে থাকে যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরল। অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পরই রবিবারই পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নতুন করে নির্বাচনের ঘোষণা করেছেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া উচিত। আমি পাকিস্তানের জনগণকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এদিকে যখন ইমরান খান জাতির উদ্দেশে তাঁর মতামত জানাচ্ছেন, তার কয়েক মুহূর্ত আগেই ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি এই অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটি ‘অসাংবিধানিক’ বলে বাতিল করে দিয়েছেন। কূটনৈতিক মহলের মতে, এতে হয়তো সাময়িকভাবে ইমরান খানের গদি বাঁচলেও, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
কূটনৈতিক মহলের একাংশের কথায়, এই প্রস্তাব বাতিলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নাও পারে বিরোধীরা। কারণ অঙ্কের হিসেবে ভোটাভুটি হলে ইমরান খানের সরকারের পতন হত। ফলে তাঁরা এবার আদালতের দ্বারস্থও হতে পারে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনীতির নাটকের সমাপন এখনই ঘটছে না।
এদিকে ইমরান খানের অবস্থা এখন ঘরে-বাইরে দু’দিকেই ‘বিপদ’। বিরোধীরা যখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, তখন তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন দলের একাংশও। যা বেশ অস্বস্তিতেই রেখেছে প্রধানমন্ত্রীকে।
অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটির আগেই শনিবার ইমরান খান জানিয়েছিলেন যে, তিনি আজ অর্থাৎ রবিবার বিরোধীদের মুখোমুখি হতে চলেছেন। দেশের মানুষকে পথে নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপনারা পথে নামুন।’ কূটনৈতিক মহলের প্ৰশ্ন, তবে কী ইমরান ভয় পেয়েছেন? সময়ই কথা বলবে।
পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম দ্য ডন জানিয়েছে, রবিবার সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের প্রতি আনুগত্য প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। তিনি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের করা আগের দাবিগুলোর কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পদক্ষেপের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গত ৭ মার্চ আমাদের রাষ্ট্রদূতকে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকে জানানো হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আসতে চলেছে। ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীরা আনুষ্ঠানিকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব আনার একদিন আগে এই ঘটনা ঘটেছিল’।
তিনি বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের বলা হয়েছিল যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এই অনাস্থা প্রস্তাবের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল। আমাদের বলা হয়েছিল যে যদি প্রস্তাবটি ব্যর্থ হয়, তাহলে পাকিস্তানের পথ খুব কঠিন হবে। এটি মূলত পাকিস্তানের সরকার পরিবর্তনের জন্য একটি একটি বিদেশী সরকারের ষড়যন্ত্র’।
এরপর তিনি, এটা কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া যায় না, মন্তব্য করে এই অনাস্থা প্রস্তাবের সাংবিধানিক বৈধতা যাচাই করতে ডেপুটি স্পিকারকে আহ্বান জানান।
ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি উল্লেখ বলেন যে, প্রস্তাবটি গত 8 মার্চ পেশ করা হয়েছিল এবং তা আইন ও সংবিধান অনুযায়ীই হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘কোন বিদেশী শক্তিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটাতে দেওয়া হবে না। মন্ত্রীর উত্থাপিত পয়েন্টগুলো ‘যুক্তিসিদ্ধ’ ছিল।
এরপর তিনি প্রস্তাবটি খারিজ করে দেন এবং রায় দেন যে এটি আইন, সংবিধান এবং নিয়মের সঙ্গে ‘বিরোধপূর্ণ’। এই রুল জারি করার পরে সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়।
সংসদ ছাড়ছে না বিরোধীরা
ওদিকে, পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল-ভুট্টো জারদারি বলেছেন যে, সরকার অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দিতে না দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে।
তিনি বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল পার্লামেন্ট ছাড়ছে না। আমাদের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন। আমরা পাকিস্তানের সংবিধান রক্ষা, সমুন্নত রাখা, সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি’।
পিপিপির মোস্তফা নওয়াজ খোখার সরকারের এই পদক্ষেপকে সংবিধান ও বিধি-বিধানের ‘স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট নিছক দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারে না এবং তা করা উচিত নয়। প্রধান বিচারপতির উচিত অবিলম্বে বেঞ্চ ডেকে দেশকে সাংবিধানিক সংকট থেকে বাঁচানো!’
পিএমএল-এন-এর আহসান ইকবাল বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন যে, তার কাছে শালীনতা, অনুগ্রহ এবং সম্মানের ‘লেশমাত্র’ নেই।
তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে তিনি সংবিধানকে মাড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতিহাসে নজিরবিহীন অপমানের সঙ্গে তিনি পরাজিত হবেন’।
বিরোধীরা অনাস্থা ভোটে জয় পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল
ইমরান খানের বিরোধীরা রবিবার সংসদ ভবনে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে যাওয়ার সময় ব্যাপক আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধীদের মোট ৩৪২ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে কমপক্ষে ১৭২ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন ছিল।
পিএমএল-এন-এর মরিয়ম নওয়াজের শেয়ার করা একটি তালিকা অনুসারে, বিরোধী দলগুলো রবিবার পর্যন্ত ১৭৪ সংসদ সদস্যের সমর্থন পেয়েছে। এছাড়া ইমরান খানের দলেরও অন্তত একডজন সংসদ সদস্য তার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার কথা বলেছিলেন।