Home Second Lead জাপানে কেন ঘন ঘন ভূমিকম্প ?

জাপানে কেন ঘন ঘন ভূমিকম্প ?

ছবি সংগৃহীত

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

একদিনে ১৫৫টি ভূমিকম্প! রিখটার স্কেলে কম্পনমাত্রা ধরা পড়েছে ৭.৫ থেকে ৭.৬। আফটার শক অগুন্তি। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে বাড়িঘর। সমুদ্র ফুঁসে উঠে প্রায় ১.৫ মিটার উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়েছে উপকূলে। ২০১১ সালের স্মৃতি উস্কে ফের ভয়াবহ সুনামির সতর্কবার্তাও জারি হয়েছে উদীয়মান সূর্যের দেশে। কিছুদিন আগেও পরপর চার বার কম্পন ধরা পড়েছিল জাপানের রাজধানী টোকিও-সহ পশ্চিমাঞ্চলের কিছু শহরে। তখনও সুনামি অ্যালার্ট জারি করেছিল জাপানের জাতীয় ভূকম্পন কেন্দ্র বা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি। কিন্তু কেন এত ভূমিকম্প হচ্ছে জাপানে? প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?

ভূকম্পন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানের ভৌগোলিক অবস্থানই ভূমিকম্পের কারণ। ভৌগোলিক দিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের রিং অব ফায়ারে রয়েছে জাপান। ওই অঞ্চলে প্রায় ৪৫২টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। মাঝেমধ্যেই জেগে ওঠে সেইসব সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ভূপৃষ্ঠের অন্দরে সবসময়েই প্রবল শক্তি তৈরি হতে থাকে। অস্থির টেকটনিক প্লেটগুলো ধাক্কা মারে একে অপরকে। কখনও একটি প্লেট ঢুকে যায় অন্য প্লেটের ভেতরে। এর কারণেও ভূগর্ভে প্রচণ্ড তাপ ও শক্তি তৈরি হয়। এই কারণেও প্রশান্ত মহাসাগরের রিং অব ফায়ার জ়োনে যে সব দেশ রয়েছে যেমন জাপান, পলিনেশিয়ার টোঙ্গো, দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর সবকটিই ভূমিকম্পপ্রবণ।

জন্মলগ্ন থেকেই পৃথিবীর পিঠ বা সারফেসে যেমন নিয়মিত রদবদল ঘটে চলেছে, ঠিক তেমনই সেই রদবদল ঘটে চলেছে পৃথিবীর অন্দরেও অর্থাৎ ভূগর্ভেও। পৃথিবীর অন্দরে রয়েছে বিভিন্ন শিলাস্তর বা টেকটনিক প্লেট। সেই প্লেটগুলি কিন্তু থেমে নেই। তারা সবসময়েই গতিশীল। প্রতিনিয়ত তারা একে অন্যকে ধাক্কা মারছে। টেকটনিক প্লেটগুলোর মধ্যে অনবরত সংঘর্ষ (কলিশন) হচ্ছে। তাতে বিপুল চাপ তৈরি হচ্ছে। সেই চাপ থেকে বল বা ফোর্সের জন্ম হচ্ছে। আর সেখান থেকেই জন্ম হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে তাপ ও গতিশক্তির। ধাক্কাধাক্কি হলেই একটা প্লেট আর একটা প্লেটের তুলনায় নীচে নেমে যাচ্ছে। একেই ভূবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’। এই গ্র্যাভিটি ফল্টের কারণেই সুতীব্র ভূমিকম্পের জন্ম হয়।

আরও বিশদে বলতে হলে, ধাক্কাধাক্কিতে যখন একটি টেকটনিক প্লেট অন্যটির নীচে চলে যায় তখন যে শূন্যস্থান তৈরি হয় তা ভরাতে সমুদ্রগর্ভে চার পাশ থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে জলরাশি। ফলে সমুদ্রগর্ভে বিপুল চাপ তৈরি হয়। জলরাশির গতিবেগও বেড়ে যায়। নতুন করে শক্তি তৈরি হয়। এই শক্তি তখন তেড়েফুঁড়ে বেরনোর চেষ্টা করে। সমুদ্রগর্ভের তলদেশ থেকে সেই জলরাশি প্রচণ্ড গতিবেগে উঠে আসে ওপরের দিকে। আছড়ে পড়ে সমুদ্রোপকূলে, ভয়ঙ্কর তীব্র গতিবেগে। নিমেষে গ্রাস করে উপকূলবর্তী জনপদকে। একেই বলে সুনামি।

ভূকম্পন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনামির অন্য কারণও আছে। সবসময় ভূমিকম্প হলেই যে সুনামির জন্ম হবে তা নয়। তবে সুনামির জন্য ভূঅভ্যন্তরে কম্পন হতেই হবে। দেখা যায়, পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে যখন একটি ভারী প্লেট অন্য একটি হাল্কা প্লেটের নীচে ক্রমশ ঢুকে যেতে থাকে, তখন ওই এলাকায় একটা ‘সাবডাকশান জোন’-এর সৃষ্টি হয়। দু’টি প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণ (ফ্রিকশান)-এর ফলে প্রচুর পরিমাণে চাপ, তাপ আর বল (Force) তৈরি হয়। এই প্রচণ্ড শক্তি যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখনই তীব্র ভূকম্প হয় সমুদ্রগর্ভে। আর সমুদ্রগর্ভে ভূমিকম্প হলেই সুনামির জন্ম হয়।

SAGE - Seismological Facility for the Advancement of Geoscience

 

রিং অব ফায়ার কেন ভূমিকম্পপ্রবণ?

 প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ জ়োনে সবসময়েই এমন বড় বড় ‘সাবডাকশান জ়োন’ তৈরি হতে থাকে। আর সেই সবগুলিই ‘অ্যাক্টিভ সাবডাকশান জ়োন’। তার ফলে, এখনও পর্যন্ত ভয়াবহ সুনামিগুলির ৮৫ শতাংশই হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। এই রিং অব ফায়ারও হচ্ছে সেই অ্যাক্টিভ সাবডাকশান জ়োন।

প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে অনেকগুলি ছোট ও বড় টেকটনিক প্লেট রয়েছে। সবচেয়ে বড়টির নাম ‘প্যাসিফিক প্লেট’। এই প্লেটই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে। আনুমানিক ৪ থেকে ৫ কোটি বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে এই প্লেট। এই প্যাসিফিক প্লেটের আশপাশেই রয়েছে ‘অস্ট্রেলিয়ান প্লেট’, ‘নাজকা প্লেট’ ও ‘নর্থ আমেরিকান প্লেট’। ‘নাজকা প্লেট’ ও ‘নর্থ আমেরিকান প্লেট’-এর মধ্যে রয়েছে আরও একটি ছোট প্লেট যার নাম ‘কোকোস প্লেট’। এগুলো সবই কন্টিনেন্টাল প্লেট, এদের নেতা হল প্যাসিফিক প্লেট। এই টেকটনিক প্লেটগুলো সবসময়েই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-অশান্তি করছে। একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে, একটি প্লেট অন্যটির নীচে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে রিং অব ফায়ার জ়োনে সবসময়েই অস্থিরতা থাকছে এবং ছোট-বড় কম্পন হয়েই চলেছে। তাই এই রিং অব ফায়ারে যেসব দেশ রয়েছে সেগুলিই ভূমিকম্পপ্রবণ। জাপানে এই কারণেই ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। একদিনে ১৫৫টি হওয়া তাই আশ্চর্যের নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যখনই ওই প্লেটগুলির মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে তখনই কেঁপে উঠবে সমুদ্রগর্ভ। ভয়ঙ্কর সুনামির জন্ম হবে, ঠিক যেমন হয়েছিল ২০১১ সালে। ফের একবার তেমনই কম্পন হচ্ছে সমুদ্রগর্ভে। তাই ফের সুনামির সতর্কতা জারি হয়েছে।