Home অন্যান্য জিল্যান্ডিয়া :পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ

জিল্যান্ডিয়া :পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ

এখনও পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে সাতটি মহাদেশের কথাই আমরা জানি। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ওশিয়ানিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকা। এর মধ্যে ওশিয়ানিয়াকে আমরা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া বলেই জানি যাকে পৃথিবীর সবথেকে ক্ষুদ্রতম মহাদেশ বলা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে। এই নতুন মহাদেশটি অবশ্য সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত রয়েছে সমুদ্রের অতলে। সদ্য আবিষ্কৃত এই নতুন মহাদেশটিকে পৃথিবীর মানচিত্রে এখনও স্পষ্টভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘ ৩৭৫ বছর ধরে ভৌগোলিক অভিযানের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস বুকে নিয়ে সমুদ্রের অতলে শায়িত পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ ‘জিল্যান্ডিয়া’ (Zealandia)।

দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের অতল সমুদ্রের নীচে সুপ্ত রয়েছে এই নতুন অষ্টম মহাদেশ ‘জিল্যান্ডিয়া’ যার ঠিক উপরেই রয়েছে নিউজিল্যান্ড। বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মত নিউজিল্যান্ড আসলে এই অষ্টম মহাদেশেরই জেগে থাকা অংশবিশেষ। আকারে-আয়তনে জিল্যান্ডিয়া মহাদেশ প্রায় ভারতীয় উপমহাদেশের সমান, অঙ্কের হিসেবে যা প্রায় ৫০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। এই নতুন মহাদেশের নিউজিল্যান্ডের উত্তর ও দক্ষিণ দ্বীপ এবং নিউ ক্যালডোনিয়া ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত অংশই এখনও নিমজ্জিত রয়েছে জলের তলায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে মানুষ বুঝতে পারল এই মহাদেশের অস্তিত্বের কথা?

এই আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে ১৬৪২ সালে। ওলন্দাজ এক নাবিক অ্যাবেল তাসমান অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে মনে করতেন যে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে নিশ্চিতরূপে একটি পৃথক মহাদেশ সুপ্ত রয়েছে। পৃথিবীর এই দক্ষিণ গোলার্ধ সেই সময় ইউরোপীয়দের কাছে অনেকটাই রহস্যাবৃত ছিল। তবে অ্যাবেল তাসমানের মত অনেক ইউরোপীয়ই বিশ্বাস করতেন যে, উত্তর গোলার্ধে তাঁদের মহাদেশের ভরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে দক্ষিণ গোলার্ধেও একইরকম একটি স্থলভূমি থাকা উচিত। সেই কল্পিত মহাদেশের নাম দিয়েছিলেন তাঁরা ‘টেরা অস্ট্রালিস’ (Terra Australis)। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এই ধারণা চলে আসছে। এই একই ধারণা বুকে নিয়ে ১৬৪২ সালের ১৪ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে দুটি ছোট জাহাজ নিয়ে তাসমান রওনা দিয়েছিলেন দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে। ক্রমে তিনি গিয়ে পৌঁছান নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপে। স্থানীয় মাওরি সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের ফল খুব একটা ভাল হয়নি। তাঁদের আক্রমণে চারজন ইউরোপীয় মারা যান। ফলত তাসমান সেই অজানা দ্বীপটির নাম দেন ‘মুর্ডেনিয়াস বে’ অর্থাৎ হত্যাকারীদের উপসাগর। এই সময়ের আগেই অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল, সেই সম্পর্কে ইউরোপীয়রা জানতেন আর তাই এই নতুন ভূমিভাগের নাম দেন তাসমান ‘টেরা অস্ট্রালিস’। অনেক অনেক বছর পরে ২০১৭ সালে ভূতাত্ত্বিকেরা প্রথম ঘোষণা করেন যে তাঁরা জিল্যান্ডিয়া নামে নতুন একটি ভূমিভাগ খুঁজে পেয়েছেন যার আয়তন ৪ কোটি ৯০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং আয়তনে তা মাদাগাস্কার দ্বীপের থেকেও ছয় গুণ বড়। এই সুপ্ত মহাদেশের প্রায় ৯৪ শতাংশই জলের তলায় নিমজ্জিত আছে বলে এতদিন কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে এই মহাদেশটি আগের মতোই রহস্যময় কারণ তা আজও প্রায় ৬৫৬০ ফুট জলের নীচে শায়িত রয়েছে।

১৬৪২ সালে তাসমানের নিউজিল্যান্ড আবিষ্কারের প্রায় এক শতাব্দী পরে ব্রিটিশ মানচিত্র নির্মাতা জেমস কুককে দক্ষিণ গোলার্ধে একটি বৈজ্ঞানিক অভিযানে পাঠানো হয়। তাঁকে মূলত পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে শুক্র গ্রহের ক্ষণস্থায়ী অবস্থা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সূর্য ঠিক পৃথিবী থেকে কতটা দূরে অবস্থিত তা নির্ণয় করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তবে তাঁর সঙ্গে একটি বন্ধ খামে দক্ষিণ মহাদেশ আবিষ্কারের একটি গোপন অভিযানের নির্দেশনামা ছিল। ১৮৯৫ সালে স্কটিশ প্রকৃতিবিদ স্যার জেমস হেক্টর নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে কয়েকটি দ্বীপের সমীক্ষা করার জন্য সমুদ্রযাত্রায় যোগ দেন এবং তিনিই প্রথম সিদ্ধান্তে আসেন যে নিউজিল্যান্ড আসলে দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে আরও বিস্তৃত একটি মহাদেশীয় ভূ-ভাগের চূড়া যার অধিকাংশই জলের তলায় নিমজ্জিত। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই অভিযানগুলি সত্ত্বেও জিল্যান্ডিয়া সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৬০-এর দশকে ভূ-তাত্ত্বিকেরা মহাদেশের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা করেন এবং এক্ষেত্রে কোনও ভূ-ভাগকে মহাদেশ হিসেবে চিহ্নিত করার পিছনে চারটি শর্তের কথা উঠে আসে। যেমন –

  • আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে খানিক উঁচু হতে হবে সেই ভূ-ভাগকে
  • সুনির্দিষ্ট কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে
  • এই ভূ-ভাগের একটি সুনির্দিষ্ট সীমানা থাকবে
  • এই ভূ-ভাগের ভূ-পৃষ্ঠের স্তর সমুদ্রের তলদেশের থেকেও অনেক পুরু হতে হবে

১৯৯৫ সালে আমেরিকান ভূ-পদার্থবিদ ব্রুস লুয়েনডিক এই ভূ-ভাগটিকে একটি মহাদেশ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং একে ‘জিল্যান্ডিয়া’ নামকরণ করার প্রস্তাব দেন। জিএনএস সায়েন্স (GNS Science) সংস্থার পক্ষ থেকে নিক মর্টিমার এই নামকরণ করার পিছনে মূলত উদ্যোগী ছিলেন। পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশের অভ্যন্তরে যেমন অনেক অনেক দেশ রয়েছে, জিল্যান্ডিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু মাত্র তিনটি এরূপ ভূ-ভাগ লক্ষ্য করা যায়। নিউজিল্যান্ড ছাড়াও নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপ, লর্ড হোয়ে দ্বীপ এবং বলের পিরামিডকে ঘিরে রেখেছে এই নতুন মহাদেশটি। এই ক্যালিডোনিয়া দ্বীপটি আসলে একটি ফরাসি উপনিবেশ যা কিনা এর উপহ্রদগুলির জন্য বিখ্যাত।

এই জিল্যান্ডিয়া আসলে বহু বহু প্রাচীনকালে আদিতম বিশালাকায় মহাদেশ গন্ডোয়ানার অংশ ছিল। আজ থেকে প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে এই ভূ-ভাগ গঠিত হয়েছিল এবং তা দক্ষিণ গোলার্ধের সমস্ত ভূ-ভাগকেই একত্রিত করেছিল। তারপর প্রায় সাড়ে ১০ কোটি বছর আগে এক অজানা প্রক্রিয়ার কারণে গন্ডোয়ানা থেকে জিল্যান্ডিয়া দূরে সরে যেতে শুরু করে। সাধারণভাবে মহাদেশীয় ভূ-ত্বক ৪০ কিমি. পুরু হয় আর এর তুলনায় সমুদ্রতলের ভূ-ত্বক মাত্র ১০ কিমি. পুরু হয়ে থাকে। জিল্যান্ডিয়া মহাদেশটি সেই সময় এতটাই প্রসারিত হয়েছিল যে সেই ভূ-ত্বক ২০ কিমি. জলের নীচে চলে গিয়েছে। এভাবেই ক্রমে ক্রমে সমুদ্রের তলদেশে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ জিল্যান্ডিয়া। এর ভূ-ত্বক অত্যন্ত পাতলা এবং জলের তলায় নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও ভূতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেছেন যে জিল্যান্ডিয়া সত্যই একটি মহাদেশ কারণ এই ভূ-ভাগে তথা মহাদেশীয় ভূত্বকে গ্রানাইট, শিস্ট ও চুনাপাথরের মত আগ্নেয় শিলা, রূপান্তরিত শিলা এবং পাললিক শিলা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশে কেবলমাত্র সমস্তত্ব ব্যাসাল্ট শিলারই আধিক্য দেখা যায়। সমগ্র জিল্যান্ডিয়া মহাদেশটি দুটি প্রায় সমান্তরাল শিলা দ্বারা গঠিত যা একটি মহাদেশীয় ফাটল দ্বারা পৃথকীকৃত রয়েছে। সমুদ্রতল থেকে এর অন্তর্গত শৈলশিরাগুলি ১০০০ থেকে ১৫০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। প্রায় ২.৫ কোটি বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের অন্তর্গত জিল্যান্ডিয়ার দক্ষিণাংশ ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের উত্তরাংশের দিকে স্থানান্তরিত হতে থাকে। ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রে আলপাইন ফল্ট (alpine fault) বরাবর প্রায় ৫০০ কিমি. চ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। সীমারেখা বরাবর এই সংকোচনের ফলে দক্ষিণ আল্পস অঞ্চল উন্নীত হয়েছিল, কিন্তু দ্রুত ক্ষয়ের ফলে তাদের উচ্চতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। ফলে সাধারণভাবে জিল্যান্ডিয়া মহাদেশটি উত্তর জিল্যান্ডিয়া এবং দক্ষিণ জিল্যান্ডিয়া এই দুই ভূ-ভাগে বিভক্ত রয়েছে বলেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন। নিক মর্টিমার এবং হামিশ ক্যাম্পবেল ২০১৪ সালে তাঁদের লেখা একটি বই ‘জিল্যান্ডিয়া : আওয়ার কন্টিনেন্ট রিভিলড’-এ জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পিছনে ভূতাত্ত্বিক ও বাস্তুতান্ত্রিক সমস্ত যুক্তিসহ বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। ২০১৭ সালে নিউ ক্যালিডোনিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মোট ১১ জন ভূতাত্ত্বিকের একটি দল অবশেষে জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশের স্বীকৃতি দিয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ড, নিউ ক্যালিডোনিয়া, নরফক দ্বীপ এবং লর্ড হোয়ে দ্বীপ মিলিয়ে পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ জিল্যান্ডিয়ার মোট জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪০ লক্ষ জন।

কিন্তু আজও ভূগোলের পাঠ্যপুস্তকে আমরা এই নব আবিষ্কৃত মহাদেশের নাম পাইনি। অদূর ভবিষ্যতে সাতটির বদলে আটটি মহাদেশের অস্তিত্বেই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। সমুদ্রের তলায় একটা আস্ত মহাদেশ লুকিয়েছিল যা খুঁজে বের করতে সময় লেগে গেল প্রায় ৩৭৫ বছর। এত বড় ও দীর্ঘকালীন ভৌগোলিক অভিযানের ইতিহাস এর আগে ইতিহাসে ঘটেনি। নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের আড়ালে এরকমই এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।