ইতিহাসে ফ্রান্সের একজন বীরাঙ্গনা নারী হিসেবে বিখ্যাত জোয়ান অফ আর্ক (Joan of Arc)। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ফ্রান্সের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলার সময় অর্লিয়েন্স দখল এবং সপ্তম চার্লসের রাজ্যাভিষেকে প্রভূত সহায়তা করার জন্যেই তিনি সুপরিচিত। মৃত্যুর চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে রোমান ক্যাথলিক গির্জা তাঁকে একজন ‘সন্ত’ হিসেবেই সম্মান করে আসছে। পরাধীন ফ্রান্সকে মুক্তি দিতে তিনি সামনের সারিতে থেকে যুদ্ধ করেন এবং ফরাসি সৈন্যবাহিনীকেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাইনি সন্দেহে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়।
আনুমানিক ১৪১২ সালে ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলীয় মিউজ নদীর তীরে ডরেমি গ্রামে (বর্তমান ফ্রান্সের লোরেন অঞ্চল) জোয়ান অফ আর্কের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল জ্যাক দি আর্ক এবং মায়ের নাম ছিল ইসাবেল রোমি। পেশায় গরীব অথচ ধার্মিক চাষী ছিলেন জোয়ানের বাবা জ্যাক। মনে করা হয় তাঁদের ৫০ একর জমি ছিল। জোয়ানের পরিবারে জোয়ান ছাড়াও আরও তিন ভাই ও এক বোন ছিল। তাঁর জন্মের সময় থেকেই ফ্রান্সে এক উত্তাল পরিস্থিতি চলছিল, ইংল্যান্ডের সঙ্গে তখন ফ্রান্সের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলছে। ফ্রান্স অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ চার্লসের মানসিক সমস্যা থাকার জন্য শাসনকার্য চালাতে অক্ষম ছিলেন তিনি। ফলে ফ্রান্সের অধিপতি কে হবেন তা নিয়ে ষষ্ঠ চার্লসের ভাই লুই, ডিউক অফ অর্লিয়েন্স এবং ভাইপো জন দ্য ফিয়ারলেস, ডিউক অফ বার্গান্ডির মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব বাধে। ১৪০৭ সালে জন দ্য ফিয়ারলেস লুই, ডিউক অফ অর্লিয়েন্সকে হত্যা করেন এবং এর ফলে প্রবল এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়। ১৩ বছর বয়সে মাঠে চাষের কাজে ব্যস্ত থাকার সময় জোয়ান অফ আর্ক প্রথম দৈববাণীর মাধ্যমে জানতে পারেন ইংরেজদের শৃঙ্খল থেকে পরাধীন ফ্রান্সকে মুক্ত করে ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করাই তাঁর জীবনের মূল উদ্দেশ্য। ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা পঞ্চম হেনরির পুত্র ষষ্ঠ হেনরি সে সময় ফ্রান্সের সিংহাসন দখল করলে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস পালিয়ে যান। অনেক চেষ্টা করে জোয়ান ফ্রান্সের পলাতক রাজার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সব কিছু জানালে তিনি প্রথমে তুচ্ছজ্ঞানে জোয়ানকে অপমান করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে জোয়ান একটি ভবিষ্যৎবাণী করেন পরবর্তী যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হবে এবং কাকতালীয়ভাবে তা সত্যি হয়ে যায়। ধর্মযাজকদের পরামর্শে তখন জোয়ানকে পঞ্চক্রুশধারী তরোয়াল এবং চার হাজার সৈন্য প্রদান করেন রাজা সপ্তম চার্লস। একটি সাদা ঘোড়ায় করে জোয়ান ১৪২৯ সালের ২৮ এপ্রিল মাত্র ষোল বছর বয়সে অর্লিয়েন্স নগরীতে প্রবেশ করেন এবং প্রথম আক্রমণেই তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। সেদিনের সাফল্য দিয়ে শুরু; এরপরে আসতে থাকে একটার পর একটা যুদ্ধ জয়ের সাফল্য। মে মাসের গোড়ার দিকে লে তুরেল দুর্গ অধিগ্রহনের যুদ্ধে একটি তীরের দ্বারা আহত হলেও জোয়ান কিন্তু বিচলিত না হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং তাঁকে দেখেই ফরাসি সেনাবাহিনী উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের পরাজয় হয়। দুর্গ চলে আসে ফ্রান্সের অধীনে এবং ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পায় বুরুজ শহর। ভাঙতে থাকে ইংরেজদের মনোবল। জোয়ান অফ আর্ক-এর নেতৃত্বে একদিন রেইমস নগরীও জয় করতে সক্ষম হয় ফ্রান্স। এভাবেই একদিন ফ্রান্স দখলমুক্ত হয় ইংরেজদের হাত থেকে। ১৬ জুলাই রেইমস নগরী স্বাধীন হয় এবং ১৭ জুলাই ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস ফিরে পান তাঁর সিংহাসন। যুদ্ধক্ষেত্রে উপযুক্ত সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের রাজসভায় একটি বিশেষ সাম্মানিক পদ দেওয়া হয়েছিল জোয়ান অফ আর্ককে। যদিও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, তবুও তাঁকে সকলের থেকে ভিন্ন করে রেখেছিল তাঁর মেধা এবং অসাধারণ বীরত্ব।
ইংরেজদের পরম শত্রু ছিলেন জোয়ান অফ আর্ক, তারা কখনও ভাবেইনি একটি কিশোরী তাদের মনোবল এভাবে ভেঙে দেবে। তাই পথের কাঁটা সরানোর চেষ্টা শুরু করল তারাও। সময়টা ১৪৩০ সালের ৩০ মে। কম্প্যেন যুদ্ধে ভাগ্য ছলনা করল জোয়ানের সঙ্গে। যুদ্ধে আহত অবস্থায় বার্গান্ডির সৈন্যরা তাঁকে বন্দি করে নিয়ে গেল। জোনকে মুক্ত করার বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখালেন না রাজা সপ্তম চার্লস যা হতভম্ব করেছিল জোয়ানকে। কারাগার থেকে বেশ কয়েকবার পালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন জোয়ান। এরপর তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে এনে রাখা হয় ৭০ ফুট উঁচু বিউভোর দুর্গে। তবু একটুও না দমে সেখান থেকেও পালানোর চেষ্টা করেন জোয়ান এবং শেষ পর্যন্ত সফল হন। কিন্তু ৭০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পরিখার জলে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন তিনি পুনরায় বন্দি হন। সে সময়ে মানুষের মন ছিল কুসংস্কারে পরিপূর্ণ যার সঠিক ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি ইংরেজরা। কোনও এক সময়ে জোয়ান অফ আর্কের করা একটি ভবিষ্যৎবাণী তাদের কানে এসে পৌঁছোলে তারা পথের কাঁটা সরানোর উপায় পেয়ে যায় খুব সহজেই। মানুষের মনে তারা এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয় জোয়ান আসলে কালো জাদু করা এক ডাইনি, নাহলে এইটুকু বয়সে এতটা নির্ভীক হওয়া অসম্ভব। এসব কথা ছড়িয়ে পরার দরুণ চার্চ প্রতিনিধিরাও বিচারে ছলনার আশ্রয় নেয়। এক ইংরেজ পাদ্রীর মাধ্যমে ১৪৩১ সালে জোয়ান অফ আর্ক-এর বিচারকার্য শুরু হয়। কোনও আইনজীবীও ছিলেন না জোয়ানের পক্ষে। ছলনার দ্বারা করা বিচারে আদালত জোয়ানকে ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে এবং বিচারে তাঁর কার্যাবলীকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁকে ‘ডাইনি’ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। যেহেতু জোয়ানের কোনও আইনজীবী ছিল না, তাই তাঁকে আদালতের নির্দেশ বিস্তারিত পড়ে শোনানোও হয়নি। ফলস্বরূপ জোয়ান তখনও বুঝতে পারেননি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাগারে জোয়ানকে মেয়েদের পোশাক পরতে বাধ্য করা হয় এবং এর পেছনেও ছিল গূঢ় কারণ। ক’দিন পর তাঁকে কারাগারের ভেতরেই ধর্ষণ করা হয়। জোয়ান বাধ্য হন আবার পুরুষের পোশাক পরতে। অর্থাৎ আদালতের নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগও ছিল তাঁর প্রতি।
অবশেষে উপস্থিত হয় সেই বিশেষ দিন। জোয়ান অফ আর্ক বন্দী ছিলেন যে কক্ষে সেখানে প্রবেশ করেন দু’জন যাজক। তাঁরা জোয়ানকে জানান বিচারক তাঁর একটার পর একটা অপরাধ ; তাঁর নারী হয়েও পুরুষের বেশ ধারণ করে যুদ্ধে যাওয়া ; ভবিষ্যৎবাণী সফল হওয়া এবং সর্বোপরি বয়স অনুপাতে তাঁর অবিশ্বাস্য কার্যাবলীর জন্য তাঁকে ‘ডাইনি’ অভিযোগে জীবন্ত দগ্ধের আদেশ দিয়েছেন। জোয়ানের আর কিছু করার ছিল না। তাঁর পুরুষের বেশ খুলে নিয়ে তাঁকে আবারও পরতে বাধ্য করা হল মেয়েদের পোশাক। তাঁর মাথায় একটা কাগজের টুপি পরানো হয় যেটিতে লেখা ছিল স্বধর্মবিদ্বেষী- ধর্মত্যাগীনি- ডাইনিসহ অনেক কিছু। ১৪৩১ সালের৩০ মে অবশেষে সীন নদীর তীরে ব্যস্ত লোকালয় রোয়াঁর বাজারে ফ্রান্সের অন্যতম বীরাঙ্গনা জোয়ান অফ আর্ককে নিয়ে এসে একটা উঁচু জায়গায় খুঁটির সাথে বেঁধে দেওয়া হয়। ঐ সময় জোয়ান কারোর থেকে একটি কাঠের ক্রুশ চেয়ে নেন। পৌরকর্তার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই তাঁর গায়ে লাগানো হয় আগুন। উইঞ্চেস্টার কার্ডিনালের তদারকিতে পোড়ানো হয় জোয়ানকে। মাত্র একবার নয় ; তাঁর দেহটা সম্পূর্ণরূপে পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত আরও দুবার আগুন লাগানো হয়। পোড়ানো সম্পন্ন হলে জোয়ানের দেহের ছাই ভাসিয়ে দেওয়া হয় সীন নদীর জলে। তবে এখানেই শেষ নয়, জোয়ান অফ আর্কের মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস তাঁর সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার নতুনভাবে শুরু করেছিলেন। সেই বিচারে জোয়ান নিষ্পাপ ও সন্ত বা ‘সেইন্ট’ (saint) প্রমাণিত হন। প্রমাণ হয়ে যায় চার্চের মিথ্যা রায় এবং শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয় জোয়ানকে। ১৯২০ সালে ক্যাথলিক চার্চ জোয়ানকে একজন সন্ত হিসেবে ঘোষণা করে। তাঁর মৃত্যুদিবস ক্যাথলিকরা এখনও উদযাপন করেন।