বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
বিশ্বে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন আমেরিকান উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন (Thomas Alva Edison)। এছাড়াও সাউন্ড রেকর্ডিং, চলচ্ছবি (Motion Picture) এবং গণ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক তাঁর অভাবনীয় সব আবিষ্কার বিজ্ঞানের অভিমুখই বদলে দিয়েছিল। প্রথম জীবনে একজন টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় এসেছিল তাঁর। মোট ১০৯৩টি মার্কিন পেটেন্ট রয়েছে এডিসনের নামে। তিনিই বিশ্বের প্রথম শিল্প-গবেষণাগার (Industrial Research Laboratory) ‘উইজার্ড অফ মিলানোপার্ক’ গড়ে তুলেছিলেন।
১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ওহিও-র মিলান শহরে টমাস আলভা এডিসনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা স্যাম একজন কানাডীয় উদ্বাস্তু ছিলেন এবং তাঁর মা ন্যান্সি ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা। প্রথমে এডিসনের মা ন্যান্সি এলিয়ট থাকতেন নিউ ইয়র্কে, যদিও পরে তাঁর পরিবার চলেও আসে কানাডার ভিয়েনাতে। সেখানেই স্যাম এডিসনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং উভয়ে বিবাহ করেন। আমেরিকার বিপ্লবের পরে এডিসনের বাবা পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসেন কানাডায় এবং ১৮৩০ সালে অন্টারিওতেও একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনে সামিল হন তিনি।১৮৩৯ সালে ওহিওতে স্যাম ও ন্যান্সি তাঁদের ঘর তৈরি করেন এবং ১৮৫৪ সালে তাঁরা মিশিগানের হার্টন বন্দরে চলে যান। সেখানেই একটি কাঠের ব্যবসার কাজ করতেন স্যাম। স্যাম ও ন্যান্সির সাত সন্তানের মধ্যে টমাস আলভা এডিসন ছিলেন সবার ছোট। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর ভাই-বোনেদের মধ্যে মাত্র চারজনই বেঁচে ছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর স্বাস্থ্য খুব একটা ভাল ছিল না। পরে ১৮৭১ সালে ১৬ বছর বয়সী মেরি স্টিলওয়েলকে বিবাহ করেন এডিসন। তাঁদের তিন সন্তানের নাম ছিল যথাক্রমে ম্যারিয়ন, এডিসন জুনিয়র এবং উইলিয়াম।
হার্টন বন্দরেই একটি স্কুলে তাঁর মা এডিসনকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য খুব একটা সবল না হওয়ায় প্রায়ই স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। সেই কারণে একটা পর্যায়ের পর তাঁর মা ন্যান্সি এডিসনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন এবং বাড়িতেই যত্ন নিয়ে পড়াতে শুরু করেন এডিসনকে। মাত্র তিন মাসই স্কুলে গিয়েছিলেন টমাস আলভা এডিসন। বাড়িতে তাঁর মা লক্ষ্য করেছিলেন যে এডিসন নিজের আগ্রহেই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করছে, এক প্রকার নিজের ইচ্ছেমত জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন টমাস আলভা এডিসন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৮৫৯ সালে ডেট্রয়েটে যাওয়ার পথে গ্র্যাণ্ড ট্র্যাঙ্ক রেলরোডে সংবাদপত্র ও মিছরি বিক্রির কাজে যোগ দেন এডিসন। হার্টন বন্দরে তিনি নিজের একটি নিউজস্ট্যান্ডের ব্যবসা শুরু করেন। সংবাদপত্র ছাপার কারখানায় কাজ করার সুবাদে সেই সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করে টমাস আলভা এডিসন পরবর্তীকালে গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক হেরাল্ড নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন এবং নিজের একটি ছাপাখানাও গড়ে তোলেন। ট্রেনের যাত্রীদের কাছে এই পত্রিকাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছোটবেলা থেকেই রাসায়নিক নানা পদার্থের বিক্রিয়া ঘটাতে ও তা পর্যবেক্ষণ করতে উৎসাহী ছিলেন এডিসন। এভাবেই একদিন ট্রেনের কামরার মধ্যে এডিসন রাসায়নিক পরীক্ষা করতে গিয়ে কামরাতে আগুন লাগিয়ে দেন। সেই থেকে ট্রেনে উঠে পত্রিকা বিক্রি করা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর, কেবলমাত্র প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই সংবাদপত্র বিক্রি করতে থাকেন এডিসন। ১২ বছর বয়সেই সমস্ত শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন টমাস আলভা এডিসন। অনেকে বলে থাকেন স্কারলেট জ্বরের কারণেই এই ঘটনা ঘটেছিল। আবার অনেকে বলেন যে ট্রেনের কামরায় আগুন লাগার জন্য ট্রেনের কন্ডাক্টর এডিসনকে প্রচণ্ড জোরে চড় মেরেছিলেন যার ফলে সম্ভবত তাঁর শ্রবণশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়। এই অক্ষমতা এডিসনকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি, বরং একেই আশীর্বাদ ভেবে তিনি আরও বেশি করে তাঁর গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেন।
১৮৬২ সালে একটি তিন বছর বয়সী শিশুকে গাড়ির চাকায় চাপা পড়া থেকে উদ্ধার করেন এডিসন। সেই শিশুর বাবা জে ইউ ম্যাকেঞ্জি এর বিনিময়ে এডিসনকে রেলরোড টেলিগ্রাফির পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। সেই বছর শীতকালেই টমাস আলভা এডিসন হুরন বন্দরে একজন টেলিগ্রাফ পরিচালকের কাজে যোগ দেন। একইসঙ্গে তাঁর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৭ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে টেলিগ্রাফ পরিচালকের চাকরি করেন এডিসন। ১৮৬৮ সালে তিনি বোস্টনে চলে আসেন এবং ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন অফিসে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এক বছর পরেই তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পূর্ণ সময়ের জন্য মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৮৬৯ সালের জুন মাসে একটি পেটেন্ট পাওয়ার জন্য ‘বৈদ্যুতিক ভোট রেকর্ডার’ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন তিনি। কিন্তু সেই যন্ত্র ব্যবহার করতে রাজনীতিবিদরা কেউই সেভাবে আগ্রহী ছিলেন না। ১৮৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে যান। সেখানে স্যামুয়েল ল’স গোল্ড ইণ্ডিকেটর কোম্পানি-তে কাজ করতেন তিনি। সেখানে তাঁকে প্রিন্টার মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয্যোগ করা হয়। এর পরে টেলিগ্রাফ বিষয়ক কাজকর্মের জন্য তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালের অক্টোবর মাসে ফ্রাঙ্কলিন এল পোপ এবং জেমস অ্যাশলের সঙ্গে একত্রে তিনি গড়ে তোলেন ‘পোপ, এডিসন অ্যান্ড কোং’। তাঁরা নিজেদের বৈদ্যুতিন প্রকৌশলী এবং বৈদ্যুতিন যন্ত্র প্রস্তুতকারক হিসেবে বিজ্ঞাপন দেন। ১৮৭০ সালে এই কোম্পানিটি ‘গোল্ড অ্যান্ড স্টক টেলিগ্রাফ কোং কোম্পানি’র সঙ্গে জুড়ে যায়। স্টক প্রিন্টার তৈরির জন্য উইলিয়াম উঙ্গারের সঙ্গে নিউ জার্সির নিউ ইয়র্কে ‘নিউ ইয়র্ক টেলিগ্রাফ ওয়ার্কস’ গড়ে তোলেন তিনি। ১৮৭৪ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের জন্য একটি কোয়াড্রুপ্লেক্স টেলিগ্রাফ তৈরি করেন তিনি যা কিনা একইসঙ্গে দুই দিকে বার্তা পাঠাতে সক্ষম ছিল। ১৮৭৫ সালে টমাস আলভা এডিসন একটি বৈদ্যুতিক কলমও তৈরি করেছিলেন। ১৮৭৬ সালে নিউ জার্সির মেনলো পার্কে তিনি একটি নতুন গবেষণাগার খোলেন। ১৮৭৯ সালে বহু গবেষণার পরে এডিসন একটি কার্বন ফিলামেন্ট তৈরি করেন যা প্রায় ৪০ ঘন্টা ধরে জ্বলবে। সেটাই প্রথম ব্যবহারিক ভাস্বর বাল্ব তৈরির প্রয়াস ছিল। বলা হয় এই বাল্ব তৈরির কাজে দশ হাজার বার ব্যর্থ হয়েও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। তিনি চেয়েছিলেন যাতে তাঁর এই বাল্বের সাহায্যে শহরের সর্বত্র বিদ্যুৎ ও আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। সেই জন্যেই টমাস আলভা এডিসন তৈরি করেন ‘এডিসন ইল্যুমিনেটিং কোম্পানি’ যা পরে ‘জেনারেল ইলেকট্রিক কর্পোরেশন’ নামে পরিচিত হয়। এই কোম্পানির সাহায্যেই ১৮৮২ সালে এডিসন ম্যানহাটনের অনেকগুলি বাড়িতেই বিদ্যুৎ ও আলোর সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হন।
১৮৮৭ সালে এডিসন পুনরায় তাঁর ফোনোগ্রাফের কাজ শুরু করেন। ১৮৮৮ সালে প্রথম কার্যকরী অডিও রেকর্ডিং যন্ত্র তৈরি মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত হন এডিসন। ইতিমধ্যে ‘ইউনিভার্সাল স্টক প্রিন্টার’ আবিষ্কার করা সত্ত্বেও ৪০ হাজার ডলারের বিনিময়ে সেই স্বত্ব তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও এডিসন আকরিক থেকে বিভিন্ন ধাতু নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার প্রতি অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। এর আগে ১৮৮১ সালে ‘এডিসন ওর-মিলিং কোং’ গড়ে তুললেও এই প্রয়াসটি ব্যর্থ হয়। ১৮৯৯ সালে তিনি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট কোম্পানি গড়ে তোলেন। কম খরচে বাড়ি নির্মাণের জন্য সিমেন্ট তৈরির চেষ্টা করছিলেন এডিসন। সিমেন্টের বদলে কংক্রিটের ব্যাপক ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি, কিন্তু যুগের থেকে এগিয়ে থাকার কারণে তাঁর এই ভাবনা সেই সময় ফলপ্রসূ হয়নি। ১৮৮৮-তে ওয়েস্ট অরেঞ্জে এডওয়ার্ড মুইব্রিজের ‘জুপ্রাক্সিস্কোপ’ দেখার পরে চলচ্ছবি নির্মাণের যন্ত্র তৈরিতে আগ্রহী হন টমাস আলভা এডিসন। ১৮৯১ সালে সফলভাবে এই যন্ত্র তৈরি করেন এডিসন যার নাম দেন তিনি ‘কাইনেটোস্কোপ’। ১৮৯৪ সালে নিউ ইয়র্কে চালু করা হয় কাইনেটোস্কোপ পার্লার এবং ১৮৯৩ সালে ওয়েয়াট অরেঞ্জে এডিসন চালু করেন একটি মোশন পিকচার স্টুডিও। এর সাহায্যেই প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরি শুরু হয়। ১৮৯৬ সালে নিউ ইয়র্কে বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন টমাস আলভা এডিসন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন সরকারের অনুরোধে এডিসন ন্যাভাল কনসাল্টিং বোর্ডের প্রধান পদে আসীন হন। মিসাইল নির্ণায়ক, অস্ত্রের উৎস খোঁজার কৌশল ইত্যাদি রক্ষণাত্মক ক্ষেত্রে কাজ করলেও এডিসন কখনই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নির্মাণে যুক্ত হননি।
১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর ৮৪ বছর বয়সে ওয়েস্ট অরেঞ্জে নিজের বাড়িতেই টমাস আলভা এডিসনের মৃত্যু হয়।