‘মহীশূরের বাঘ’ টিপু সুলতান ছিলেন ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান শক্তি। মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানই প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রকেট-প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে নেপোলিয়নের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করে ব্রিটিশ আধিপত্য খর্ব করতে চেয়েছিলেন তিনি। একইসঙ্গে ভারতের ইতিহাসে ‘টিপু’ এক বিতর্কিত নাম। দক্ষিণ ভারতের এই রাজা ইতিহাসে ‘নায়ক’ নাকি ‘খলনায়ক’ তাই নিয়ে বহু মতানৈক্য রয়েছে। আজও তাঁর জন্মদিন পালন নিয়ে কর্ণাটকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্ম হয়। তবু উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বলেই খ্যাত, কিন্তু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে মালাবারে হিন্দুদের ও ম্যাঙ্গালোরে খ্রিস্টানদের দমন করার জন্য তিনি বহুল সমালোচিত।
১৭৫১ সালের ১ ডিসেম্বর সেকালের মহীশূরের দেভানাহ্ল্লি-তে (অধুনা ব্যাঙ্গালোর) টিপু সুলতানের জন্ম হয়। তাঁর সম্পূর্ণ নাম সুলতান ফতেহ্ আলি সাহাব টিপু। তাঁর বাবা বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ হায়দার আলি তামিলনাড়ুর আর্কট-এর এক সাধু টিপু মস্তানা আউলিয়ার নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন টিপু। স্থানীয় মহীশূরের ভাষায় ‘টিপু’ শব্দের অর্থ হল ‘বাঘ’। তাঁর মায়ের নাম ফতিমা-ফক্র-উন্নিসা যিনি কাদাপা’র দূর্গের শাসক মীর মঈনুদ্দীনের কন্যা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বাবা টিপুকে স্বাধীনভাবে সৈন্যাভিযানের সিদ্ধান্ত নিতে শেখান। মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকেই তাঁর বাবার পরামর্শে টিপু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও সামরিক অভিযানের দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। হায়দার আলি মহীশূরের একজন সৈন্যাধ্যক্ষ হওয়ার সুবাদে যে সামরিক সংঘর্ষগুলির মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ ভারতের শাসনভার অধিকার করেন, টিপু সেই রণাঙ্গনে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ১৭৬৬ সালে টিপু প্রথম মহীশূরের যুদ্ধে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বাবার সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। ১৭৭৫ থেকে ১৭৭৯ সাল পর্যন্ত চলা ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধেও টিপু সুলতান তাঁর নিজের কৃতিত্বের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরেন।
টিপুর প্রাথমিক শিক্ষা ঘটেছিল মূলত রণকৌশলে, সমর-বিদ্যায়। কিন্তু তার পাশাপাশি তাঁর বাবা হায়দার আলি তাঁকে উর্দূ, আরবি, ফার্সি, কন্নড় ইত্যাদি ভাষা শিখিয়েছিলেন। কুর্-আন্-শরীফ পাঠ, ইসলামি শাসনব্যবস্থার শিক্ষাও তিনি গ্রহণ করেন। অনেক অল্প বয়স থেকে অশ্বারোহণ, তীরন্দাজি ও শ্যুটিং কিংবা তলোয়ার চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৭৭৯-তে ফরাসি-নিয়ন্ত্রিত মাহে’র দূর্গ ব্রিটিশরা আক্রমণ করলে হায়দার আলি কর্ণাটক অভিযান করেন। প্রায় ১০ হাজার সৈন্য এবং ১৮টি বন্দুকসহ একটি বাহিনী হায়দার পাঠান টিপুর সুরক্ষার জন্য। পলিলুরের যুদ্ধে টিপু কর্নেল বেইলিকে পরাস্ত করেন ও প্রায় ৩৮০০ জন ইউরোপীয় সেনা হতাহত হয়। স্যার হেক্টর মুনরো টিপুর আক্রমণে ভীত হয়ে মাদ্রাজে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এভাবে দ্বিতীয় মহীশূরের যুদ্ধ চলাকালীন ১৭৮১ সালে চিতোর দূর্গ দখল করেন টিপু। পরের বছরই ১৭৮২-তে তাঁর বাবা হায়দার আলি মারা গেলে ঐ বছর ২২ ডিসেম্বর টিপু সুলতানের রাজ্যাভিষেক ঘটে মহীশূরের রাজা হিসেবে। ততদিনে ম্যাঙ্গালোরের চুক্তির ফলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূরের যুদ্ধ সমাপ্ত।
মহীশূরের রাজা হিসেবে টিপুর রাজ্যশাসনের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা মারাঠা-মহীশূর সংঘাত। মারাঠা পেশোয়া মাধবরাও-এর কাছে তাঁর বাবা হায়দার আলি পরাজিত হলেও স্বাধীনচেতা টিপু মহীশূরের উপর থেকে মারাঠা আধিপত্য প্রত্যাহার করতে চাইলে যুদ্ধ বাধে। ১৭৮৭’র গজেন্দ্রগড়ের সন্ধির মাধ্যমে টিপু হায়দার আলি অধিকৃত মারাঠাদের অঞ্চলগুলি ফিরিয়ে দেন। দ্বিতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধে ইংরেজদের প্রতিহত করাই ছিল টিপু সুলতানের একমাত্র লক্ষ্য । কিন্তু এর জন্য তাঁকে একা হাতেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল, কারণ এই সময় কোনো ভারতীয় শক্তি টিপু সুলতানকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। বরং অন্য দিকে কিছু ভারতীয় শক্তি ইংরেজদের সাহায্য করেছিল । সেজন্য টিপু সুলতানকে একসঙ্গে ইংরেজ এবং কিছু ভারতীয় শক্তি, যেমন হায়দরাবাদের নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল । ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য টিপু সুলতান ফরাসিদের কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠিয়েছিলেন। তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের প্রাক্কালে ইংরেজরা হায়দরাবাদের নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে আঁতাত করে। ত্রিবাঙ্কুরের রাজা ইংরেজদের সহযোগী ছিলেন । স্বাধীনচেতা টিপু সুলতান ইংরেজদের প্ররোচনামূলক কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৭৮৯ সালে ইংরেজদের আশ্রিত ত্রিবাঙ্কুর রাজ্য আক্রমণ করলে ১৭৯০ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের যুদ্ধের সুত্রপাত হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম এই ত্রিশক্তি টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ১৭৯০ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত দুই বছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যান টিপু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হতে পারেননি। দীর্ঘদিন তাঁর রাজধানী অবরোধের পর টিপু সুলতান ১৭৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ও ১৭৯২ সালের মার্চ মাসে শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই সন্ধির মাধ্যমে টিপু সুলতান ও কর্ণওয়ালিশ এই যুদ্ধের অবসান ঘটান । এর ফলে দাক্ষিণাত্যে টিপুর প্রভাব খর্ব হয়ে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
মহীশূরের রাজা এবং দাক্ষিণাত্যে অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হওয়ার সুবাদে ভারতের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নৌ-শক্তি, ধর্মীয় অনুশাসন সবেতেই টিপুর কিছু না কিছু প্রভাব ছিল। এখানে সংক্ষেপে তাঁর কিছু বিশেষ অবদান তুলে ধরা যেতে পারে- মহীশূরের রকেট প্রক্ষেপণ ব্যবস্থার জনক ছিলেন টিপু সুলতান। পলিলুরের যুদ্ধে তিনিই প্রথম ব্রিটিশদের প্রতিহত করতে এই নবতর অস্ত্র কৌশল ব্যবহার করেন। মহীশূরের রেশম শিল্পের উত্থান ঘটে টিপু সুলতানের রাজত্বকালেই। পরে বাংলা সুবাতেও রেশম শিল্পের বিকাশ ঘটে। একটি হিন্দু রাষ্ট্রের মুসলিম শাসক হওয়া সত্ত্বেও টিপু ১৫৬টি হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। রাজ্যশাসনকালে ব্রিটিশ বিরোধিতার সূত্রে তিনি ফরাসি সাম্রাজ্যের সম্রাট নেপোলিয়ন এবং অটোমান সম্রাটের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন।
ইংরেজরা তাঁকে ‘শের-ই-মহীশূর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর কিংবদন্তীতে বাঘের একটি গুরুত্ব আছে। বাবার মৃত্যুর পরে তিনি সিংহাসনে বসলে শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে তিনি যে আসনটি নির্মাণ করান তার মাঝখানে একটি বাঘের মূর্তি ছিল বলে শোনা যায়। তাঁর রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ। রাজ্যের পতাকায় কন্নড় ভাষায় লেখা ছিল ‘বাঘই ঈশ্বর’। কিশোর বয়স থেকে তিনি বাঘ পোষাও শুরু করেন। তাঁর পরিধেয় পোশাক, রুমাল ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা এমনকি তাঁর ব্যবহারের তলোয়ারের হাতলে বাঘের মাথা খোদিত ছিল। আর সবশেষে একটি আশ্চর্য ঘটনা বলতেই হয়। ফরাসি যন্ত্রনির্মাতাদের দ্বারা তিনি বিরাটাকায় দম দেওয়া নকল বাঘ তৈরি করেন যা ‘টিপু’স টাইগার’ (Tipu’s Tiger) নামে পরিচিত। এই যন্ত্রে দম দেবার পরে একটি অর্গান পাইপ দিয়ে বাঘের গর্জন আর কোনো এক ইংরেজের আর্তনাদ শোনা যেত। যন্ত্রটি দেখতে এরকম ছিল – একটি বিশালাকার বাঘ একজন ইংরেজকে আক্রমণ করেছে আর অসহায় ইংরেজের বুকে বাঘটি কামড় বসানোর সময় ভেসে আসতো মহীশূরের রাজার প্রিয় গজলের সুর। এই ‘টিপু’স টাইগার’ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে টিপুর ঘৃণা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
ভারতীয়দের মধ্যে টিপু সুলতানকে নিয়ে এই আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয় ডিডি ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে একদা সম্প্রচারিত ভগবান এস গিয়োদানি’র লেখা ‘দ্য সোর্ড অফ টিপু সুলতান’ নামক ধারাবাহিকটি। টিপু একদিকে বীর দেশপ্রেমিক অন্যদিকে আবার কারও কারও মতে ন্যক্কারজনক খলনায়ক। সন্দীপ বালকৃষ্ণা তাঁর বই ‘টিপু সুলতান : দ্য টায়র্যান্ট অফ মহীশূর’-এ টিপুর বিরুদ্ধে হিন্দু মন্দির ও খ্রিস্টান-চার্চ ধ্বংস এবং বহু বিধর্মীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার ঘৃণ্য অপরাধের প্রশ্ন তুলেছেন। কর্ণাটকে সরকারিভাবে পালিত হওয়া ‘টিপু জয়ন্তী’ বন্ধ করে দেয় বিজেপি ও আর.এস.এস সংগঠন। কুর্গ ও মালাবারে বহু হিন্দু হত্যা ও বলপূর্বক ধর্মান্তরিকরণের দায়ে টিপু সুলতানকে বাদ দিতে চায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সমস্ত সংগঠনগুলি। টিপু যে আজও ভারতের ধর্মীয় বিতর্কের কেন্দ্রে তা এর মাধ্যমেই বোঝা যায়। তাঁর বংশের উত্তরাধিকারীরা কেউ কেউ কলকাতায় চলে এসেছিলেন বলে কলকাতায় তৈরি হয়েছে ‘টিপু মসজিদ’, এমনকি টিপুর পুত্র আনোয়ার শাহের নামে রয়েছে বিখ্যাত সড়ক।
১৭৯৯ সালের ৪ মে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূরের যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়ে রণাঙ্গনেই টিপু সুলতানের মৃত্যু হয়।