প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এদেশে রয়েছে- বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত-কক্সবাজার, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চাল-সুন্দরবন, রয়েছে সমুদ্রকণ্যা-কুয়াকাটা, এবং অতীতকে স্বাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দেশের অসংখ্য হাওর-নদী-নালা-খাল-বিল ও নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র।সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিকে আরোও সমৃদ্ধ করেছে ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি’র নয়নাভিরাম চারণ ভূমি সিলেট, চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চলের সবুজ শ্যামলে ঘেরা চোখ জোড়ানো চা বাগান। বর্তমান সরকার পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করার জন্য বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য টুরিস্ট পুলিশ গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নসহ পর্যটকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলে দেশী বিদেশী প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটবে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
পৃথিবীতে ‘টি টুরিজ্যম’ একটি নতুন ধারণা এবং জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় সেক্টর। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০ টিরও বেশী দেশে চা উৎপাদিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত, শ্রীলংকা, চীন, ইন্দোনেশিয়াতে চা পর্যটন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশ্বে চা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত স্থানসমূহের মধ্যে ভারতের দার্জিলিং ও আসাম’ চীনের লঙ্গিং টি এস্টেট, উনি মাউন্টেন, জিজং, আনহুই, হাংজু প্রদেশ; জাপানের উজি, শ্রীলংকার নুয়ারা, এলিয়া; তুর্কীর রাইজ; কেনিয়ার কেরিকো। চা পর্যটন বলতে বুঝায় চা বাগানের ভিতরে চিরসবুজের বুকে প্রাকৃতিক মনোরাম পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো, ব্রিটিশ কর্তৃক তৈরিকৃত চা বাগানের বাংলোতে কিছুদিন অতিবাহিত করা, বাগানের অর্গানিক ফলমূল খাওয়া, সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ সতেজ চা খাওয়া, চা শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাত করা এবং চা কন্যাগণ কিভাবে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তুলে তা দেখা ও শ্রমিকদের জীবনমান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। এছাড়াও শ্রমিকরা কিভাবে চা পাতা উত্তোলন করে মাথায় বা পিঠে করে নিয়ে যায়, কিভাবে চা কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণ করে তা উপভোগ করা। সর্বোপরি, চা শ্রমিক কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে ধারনা নেওয়া। আর্ন্তজাতিক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হলোঃ চায়ের পাতা তোলা দেখা (৩১ শতাংশ); চা বানানোর প্রক্রিয়া (১৭ শতাংশ); চা ফ্যাক্টরি পরিদর্শন (১২ শতাংশ); বাগানের সৌন্দর্য (১৫ শতাংশ); বাগান থেকে চা কেনা (১৬ শতাংশ) ও চা শ্রমিকদের সংস্কৃতি (৯ শতাংশ)। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান যেমন ভারত ও দার্জিলিং চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। ভারতের দার্জিলিং এ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালোমানের চা পাওয়া যায়। দার্জিলিং এর চা বাগানগুলিতে ব্রিটিশ আমলের তৈরিকৃত বাংলোগুলিতে প্রচুর পর্যটক আগমন করে। চা এর উৎপত্তি প্রথম চীনে। চীনের চা বাগানগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। চীনের চা বাগান দেখার জন্য প্রচুর পর্যটকদের আগমন ঘটে। চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে প্রচুর চা উৎপন্ন হয় যেখানে প্রচুর পর্যটকের আগমন করে থাকে। এছাড়াও ফুজিয়ান প্রদেশে জ্যাংজু সিটিতে একটি টি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা দেখতে পর্যটকরা ভীড় জমিয়ে থাকে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, চীনের মতো চা পর্যটনে বাণিজ্যিকভাবে রুপ দিতে প্রবেশ মূল্য, ট্যোর গাইড, রেস্টুরেন্ট ও বিশ্রামাগার, টি স্যুভেনির শপ, লাইভ টি স্টল, টি ট্যোরিজমের প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে।
বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান ও আট সহস্রাধিক ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে বাংলাদেশকে তিনটি চা অঞ্চল যথা- সুরমা ভ্যালীস্থ সিলেট অঞ্চল, হালদা ভ্যালীস্থ চট্টগ্রাম অঞ্চল ও করতোয়া ভ্যালীস্থ উত্তরাঞ্চল এ ভাগ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জেলাওয়ারী পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ১৬৭টি চা বাগানের ৯১টি মৌলভীবাজার জেলায়, ২৫টি হবিগঞ্জ জেলায়, ১৯টি সিলেট জেলায়, ২১টি চট্টগ্রাম জেলায়, ২টি রাঙ্গামাটি জেলায়, ৮টি পঞ্চগড় জেলায় ও ১টি ঠাকুরগাঁও জেলায় অবস্থিত।২০২১ সালে বাংলাদেশের ১৬৭টি চা বাগান ও আট সহস্রাধিক ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের ১ লক্ষ ৬৩ হাজার একর জমিতে ৯৬ দশমিক ৫০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। বিশ্বে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। বাংলাদেশেও চা পর্যটন থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল-কে বলা হয় চা-এর রাজধানী। চা বাগানগুলি সবুজ কার্পেটের মত এমনভাবে বিছানো যা দেখলে পর্যটকদের চোখ জুড়িয়ে যায়। শ্রীমঙ্গলে চা বাগানের প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রচুর পর্যটক আগমন করে থাকে। এই পর্যটকদের উপর ভিত্তি করে প্রচুর হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। যেখানে ২০০৪-২০০৫ এর দিকে শ্রীমঙ্গলে মাত্র তিন চারটি গেস্ট হাউজ ছিল, বর্তমানে পাঁচ তারকামানের হোটেলসহ চা বাগান ঘিরে প্রায় শতাধিক ছোট বড় গেষ্টহাউজ গড়ে উঠেছে। সরকারীভাবে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম রয়েছে। উক্ত টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম টি সিলেট অঞ্চলের প্রথম দিকের একটি উন্নতমানের হোটেল। উক্ত টি রিসোর্টটি চারিদিকে চা বাগানদ্বারা পরিবেষ্টিত। রিসোর্টটিতে বিভিন্ন পাহাড়ি টিলায় আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ ১৫টি পৃথক বাংলো, ক্যফেটেরিয়া, কীডস প্লেয়িং কর্নার, লন টেনিস কোর্ট রয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিকমানের আরেকটি রিসোর্ট ভবন তৈরি করা হয়েছে। চায়ের রাজ্যখ্যাত শ্রীমঙ্গলের চা বাগান সংলগ্ন এই রিসোর্টটিতে সারাবছর প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে থাকে। উক্ত রিসোর্টটিতে ২০০৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে একটি টি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয় যা বাংলাদেশের প্রথম ‘টি মিউজিয়াম’। উক্ত টি মিউজিয়ামে চা শিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্বলিত অনেক পুরাতন জিনিসপত্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ড এর চেয়ারম্যান থাকাকালীন ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল। বঙ্গবন্ধু ০৪ জুন ১৯৫৭ থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ খ্রি.পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। উক্ত টেবিলটি টি মিউজিয়াম-এ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যা দেখে পর্যটকরা খুবই মুগ্ধ হয়ে যান।
আরো উল্লেখ্য, টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের এক কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ সংস্থা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) অবস্থিত। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ চা গবেষণা কেন্দ্রে সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। এখানে আসলে দর্শনার্থীরা বাগানের মনোরম পরিবেশ উপভোগ থেকে শুরু করে চা পরীক্ষণ খামার, চা প্রক্রিয়াজাত পদ্ধতি ও চায়ের নানা বিষয় প্রত্যক্ষ করতে পারে। এছাড়া বিটিআরআই রেস্ট হাউসে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। চা বাগানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শ্রীমঙ্গলে মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নানা ধরনের হস্তশিল্প ও নৃত্য এবং মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়াদের জীবনযাপন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। হোটেল রেস্তোরাঁতে ব্লাক টি ও গ্রিন টি’র পাশাপাশি থাকছে নানা ধরনের ফ্লেভার টি ও সাত রংয়ের চা। আর শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এসে চা এবং সাতকরা (লেবু জাতীয় ফল) না কিনে তো ফেরাই যাবে না।
উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড় চা শিল্পে তৃতীয় অঞ্চল হয়ে উঠায় টি ট্যুরিজমের প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখানকার মনোমুগ্ধকর এই চা বাগানগুলো পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত মনোরম ও উপভোগ্য। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মন জুড়িয়ে দেয়। বাগানগুলোতে যদি পর্যটকদের ভ্রমণ বিলাসের জন্য বিশেষ রিসোর্ট, হোটেল ও বাংলো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পর্যটন শিল্পে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় এখানকার চা শিল্প টি ট্যুরিজমে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে। এখানে পর্যটকরা এসে এপার-ওপার বাংলার আন্তঃসীমানা চা বাগান উপভোগ করতে পারছেন। এছাড়া সমতল ও কোথাও উচু-নিচু ঢেউ তোলা জমিতে বিস্তৃত চা বাগানের সবুজের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেকোন সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকের মন কাড়বে। তাছাড়া এখানে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক চা বাগান, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। প্রতিদিন অগণিত পর্যটক এখানকার দর্শণীয় স্থানসমূহ দেখা ছাড়াও অতি আগ্রহে চা বাগানগুলোতে দেখছে, ছবি তুলছে, সে ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন ভরে গেছে চায়ের সবুজ পাতায়। কোথাও কোথাও চা বাগানের মাঝে দেখা মিলছে বাড়িঘর। এতে সৃষ্টি হয়েছে মুগ্ধকর সৌন্দর্য। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে পর্যটকের কাছে তুলে ধরতে গড়ে তোলা যেতে পারে টি ট্যুরিজম। তেঁতুলিয়া রওশনপুরের জেমকন গ্রুপের কাজী এন্ড কাজীর টি এস্টেটে ‘আনন্দধারা রিসোর্ট’ যা পর্যটকদের জন্য বড় একটা আকর্ষণ কিন্তু এখানে প্রবেশাধিকার সীমিত। পঞ্চগড়ে নদীর তীরবর্তী বেশ কিছু চা বাগান যেমন- ডাহুক টি এস্টেট, করতোয়া চা বাগান, সীমান্তবর্তী কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট, স্যালিলান টি এস্টেট, ট্রিপল জেড টি এস্টেট, এম এম টি এস্টেট, ময়নাগুড়ি টি এস্টেট ও ঠাকুরগাঁও এর গ্রীন ফিল্ড টি এস্টেট টি ট্যুরিজমের গুরুত্ব বহন করছে। বিশেষ করে সীমান্ত ও নদীর কিনার সংলগ্ন স্থানগুলোতে যেসব একরের একর চা বাগান রয়েছে, এসব চা বাগানগুলো পর্যটকদের বেশ দৃষ্টি কাড়ছে। সীমান্তের কাঁটাতারও যেন ঢাকা পড়েছে সবুজের সমারোহে।
চা পর্যটনের এই বিকাশমান সেক্টরকে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নিকট আরো বেশি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্টপোষকতার সুযোগ রয়েছে-যা পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাবে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সূত্র: টি২৪.কম