Home First Lead দর্জিদের রোজগারে টানাপোড়েন

দর্জিদের রোজগারে টানাপোড়েন

সুমন চৌধুরী

চট্টগ্রাম: করোনাভাইরাসের থাবায় স্কুলগুলো  নিস্তব্ধ। শ্রেণি কক্ষে ঝুলছে তালা। অযত্নে আর ধুলোবালিতে একাকার বেঞ্চগুলো। বাজে না দপ্তরীর দেয়া ঢং ঢং ছুটির ঘন্টা। মহামারীর শুরুতে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে দূরত্ব থাকলেও অনলাইনে ক্লাস চালু হওয়ার পর মোবাইল ফোনের পর্দায় ক্ষণিকের আলাপ চলছে। তবু সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্কুলে শ্রেণি শিক্ষকদের হাজিরা খাতা আলমারিতে বন্দী। হেড মাস্টারের কাছে নেই কোনো অভিভাবকের আপত্তি-আবদার ও অভিযোগ। স্কুল না খোলার আভাসে নতুন শ্রেণিতে নতুন জামা পরিধান করে পাঠ বুঝে নেয়াটাও অনিশ্চিত। বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। টেইলারদের সেলাইর মেশিনও আক্রান্তের পথে।

নভেম্বর-ডিসেম্বরে স্কুল শিক্ষার্থীদের পোশাক সেলাই করে ভালো আয় করতো টেইলার্স ব্যবসায়ীরা। চুক্তিতে বিভিন্ন স্কুলের ড্রেস তৈরির কাজ পেত। এখন রোজগার কমেছে। কিছুটা লেডিস আইটেমের কাজ হলেও তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানসহ পরিবার চালাতে টানাপোড়েন অবস্থা। পাঁচটি সেলাইর মেশিন থাকলেও চলছে না সব। রোজগার কম থাকার কারণে কর্মচারীর সংখ্যাও কমেছে। সেলাইয়ের জন্য ভাড়া নেয়া কারখানায় তালা ঝুলার অবস্থা।

দেখা গেছে, কাপড় কিনে মাপ দিয়ে সেলানোর চেয়ে রেডিম্যাট তৈরি পোশাকের চাহিদা বেশি। পুরুষেরা কোমরের সাইজ বললেই প্যান্ট বের করে দিচ্ছে দোকানি। পরে ইচ্ছে মত লাম ছোট করে সেলাই করার কাজ। শার্টের ক্ষেত্রেও একই। মেয়েদের থ্রিপিচ,মহিলাদের পেটিকোট-ব্লাউজও বিভিন্ন সাইজের বিক্রি হচ্ছে। দামাদামি না করার জন্য মূল্যও রয়েছে কাপড়ের ওপর সাঁটানো।

এক সময় মাপ দিয়ে প্যান্ট-শার্ট, সুট-কোট, ব্লেজার ইত্যাদি সেলাই করার জন্য ভিড় লেগে থাকত নগরীর জহুর হকার্স মার্কেটে। কাপড়সহ সেলাই করত এমন দোকানের সংখ্যাও বিপনি বিতানগুলোতে ছিল না।

ঈদ উৎসব থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য প্যান্ট এবং শার্ট সেলাই করতে ছুটে আসত নবীন-প্রবীণেরা। টেইলার দোকানের সংখ্যাও অনেক কম। মার্কেটটির ভিতরে চলাচলের দুটি লাইন রয়েছে। ১নং লাইনের থেকে ২নং লাইনে টেইলারের দোকান ছিল বেশি। কেনাকাটার উদ্দেশ্য ছাড়াও ওই লাইন দিয়ে চলাচল করলে দোকানিরা ডাকাডাকি করতো। যেন ক্রেতা ধরার জন্য দোকানিরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মাঝারি ও ছোট্ট সরু দোকানে ছিল বড় দোকানের চেয়ে কর্মচারীর সংখ্যা অনেক। ক্রেতা ডাকা থেকে শুরু করে মাপজোপ, ইঞ্চি-ব্যাস লিখা ও ডেলিভারি দেয়ার কারণে তাদের খুচরা আলাপের ফুসরত ছিল না। তারিখ মত স্লিপ নিয়ে হাজির হলেই দোকানের একপাশে লাগানো চিকন সিঁড়ি দিয়ে উপর থেকে মাল চলে আসত। মার্কেট খোলা থেকে বন্ধ পর্যন্ত মেশিনের গ্যারগেরানি শব্দে মুখরিত থাকত। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা নেই বললে চলে। দোকানিরা এখন ব্যবসার ধরণও পাল্টে ফেলেছ। ফিতা দিয়ে মাপজোপের পরিবর্তে সাজিয়ে রেখেছে রেডিম্যাট প্যান্ট-শার্ট, কোর্ট ব্লেজার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিপনি বিতানগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে করা হয়েছে দোকানের ডেকোরেশণ। মেঝেতে টাইলস্ আর ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগানো হয়েছে হরেক রঙের বাতি। শোতে পুতুলের গায়ে সাজিয়ে রেখেছে প্যান্ট-শার্ট। খোপওয়ালা থাকের মধ্যে রয়েছে বাকি মালামাল। প্রায় দোকানেই গার্মেন্টেসের তৈরি পোশাক। তবে টেইলারের সংখ্যা কমেছে। মার্কেটটির বাহিরে অপর এক গলিতে সেলাই মেশিন নিয়ে প্যান্ট ছোট করা ছাড়া কাপড় কেটে তৈরির কাজ চলছে না।

হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী হামিদ জানান, আমি ২৫ বছর এখানে টেইলার ব্যবসা করছি। আগের মত ব্যবসা এখন নেই। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। না হয় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ড্রেস তৈরির অর্ডার পেতাম। এখন তা মিলছে না। তাছাড়া মাপ দিয়ে কাপড় সেলানোর চেয়ে এখন রেডিমেট প্যান্ট-শার্টের চাহিদাই বেশি।

কেনাকাটা করতে আসা লাভলেইনের বাসিন্দা আদনান জানান, ছোট থাকতে বাবার সাথে এই মার্কেটে জামা কাপড় সেলাই করতে আসতাম। এখন রেডিম্যাড ভালো জামাকাপড় পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া টেইলারের দোকানে কাপড়সহ একটি শার্টের পিছনে ৮শ’ থেকে ১হাজার টাকা খরচ হয়। সেদিক থেকে ৬/৭ শ’ টাকার মধ্যে ভালো মানের শার্ট কিনা যায়।

থান কাপড় ব্যবসায়ী মো. আমিন জানান, একদিকে করোনা অন্যদিকে সুতার দাম বাড়ার কারণে কাপড়ের দামও বেড়েছে। চাহিদা মত কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেতার সংকটও চলছে। এই ব্যবসা ছাড়া অন্য ব্যবসা করারও পুঁজি নাই।

ব্যাংকক সিঙ্গাপুর মার্কেটের টেইলার দোকানের কাছ থেকে সাবকন্ট্রাকে কাজ করা বিউটি আক্তার জানান, করোনার জন্য এবার রমজানেও ঢিলেঢালা কাজ করেছি। তবে বেশিরভাগই রেডিম্যাট (মাপ দিয়ে গলা, হাত আর লম্বা কেটে সেলাই করে দেওয়া)। আগে আলাদা আলাদা কাপড় কেটে দোকান থেকে আমাদের কাছে পাঠাত। তাছাড়া এখন মেয়েরা অনলাইনে জামা কিনে। সেগুলোতো রেডিম্যাডের মতই।