ডা. আরিফা আকরাম
মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা ২২ বছরের রায়হান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে গত ২ আগস্ট রায়হানকে ঢাকার হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। রায়হানের আত্মীয় পরিচয়ে মাসুদ বলেন, ‘ঢাকার কোনো হাসপাতালে বেড পাচ্ছি না। এখন তাকে নিয়ে কোথায় যাব।’ কোথায় একটা বেড পাবে-সেটাই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যায় ফরিদপুরের মাধবী চক্রবর্তীকে, বয়স ৭২ বছর। জ্বরের পর পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে শরীর অবনতির দিকে গেলে তাকে ঢাকায় রেফার করেন চিকিৎসকরা। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু হাসপাতালের নতুন ভবনের সপ্তম তলায় তার ঠাঁই হয়েছে চিকিৎসকদের রুমের সামনের জায়গায়। পাশের রেলিংয়ের সঙ্গে ঝোলানো হয়েছে তার স্যালাইন।
তাতেও আপত্তি নেই মাধবী চক্রবর্তীর পরিবারের। স্বজনরা জানালেন, ‘চিকিৎসা হচ্ছে, আগের তুলনায় ভালো আছেন তিনি।’
এভাবেই রাজধানীর দিকে ছুটছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। কেউ নিজের ইচ্ছায় আবার কেউবা চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় এসেছেন। যার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাপ পড়েছে। রোগী ধারণক্ষমতার প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘অনেক রোগীকেই ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এখানে রেফার করা হচ্ছে-এটা আমাদের কাছে এক বিস্ময়।’
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। ইতোমধ্যেই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়েছে। মোট রোগী সংখ্যায় সেটা এখনো না হলেও অন্য বছরের তুলনায় প্রথম সাত মাসে এত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। বিশেষজ্ঞরা আগেই জানিয়েছিলেন, চলতি বছর ডেঙ্গু তার ভয়ংকর রূপ দেখাবে, আর বর্ষা মৌসুম বাকি থাকতেই সেদিকেই হাঁটছে দেশ।
আগে ডেঙ্গুকে শহরের অসুখ বলা হলেও গত কয়েক বছরে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও সমানতালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিত ও পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার কারণে রোগীরা ঢাকামুখী হচ্ছেন। যার কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে, চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের হিমশিম খাবার মতো অবস্থা। তারা বলছেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি না থাকার দরুন সেখানে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এর প্রকোপ হবে আরও ভয়াবহ।
খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজধানীতে স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুজ্বর সংক্রমণের হার কিছুটা বাড়ছে।
গত বুধবার দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের হার মোটামুটি স্থিতিশীল, তবে ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বাড়ছে।’
চলতি বছরে ঢাকার চাইতে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে বেশি রোগী ভর্তির তথ্য প্রথম দেয়া হয় গত ২০ জুলাই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেদিন ডেঙ্গু রোগী ভর্তির নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সেদিন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৭৫৫ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৪৫ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯১০ জন। এরপর ২৩ জুলাইতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ২৯২ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৬৪ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ২২৮ জন।
এরপর থেকে রোগীর সংখ্যা ঢাকার বাইরের হাসপাতালেই বেশি বলে জানাচ্ছে অধিদপ্তর। গত ৩০ জুলাই ২ হাজার ৭৩১ জনের মধ্যে ঢাকা মহানগরের হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ১৮৪ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৪৭ জন। ৩১ জুলাই ২ হাজার ৬৯৪ জনের মধ্যে ঢাকা সিটির হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৬৮ জন আর ঢাকা সিটির বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫২৬ জন।
১ আগস্টে ২ হাজার ৫৮৪ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ১৩১ জন আর ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৪৫৩ জন, ২ আগস্ট ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ১৩০ জন আর ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৫৮১ জন, ৩ আগস্ট ঢাকায় ১ হাজার ১০১ জন আর ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৪৮৮ জন এবং ৫ আগস্ট ২ হাজার ৪৯৫ জনের মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৬৯ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪২৬ জন।
এদিকে, চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ হতে পারে মারাত্মক, সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত জানুয়ারিতে ডব্লিউএইচও সতর্ক করে বলেছিল, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগগুলোর মধ্যে বর্তমানে ডেঙ্গুই বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা মহামারিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বর্তমানে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুকে এখন মহামারি হিসেবে গণ্য করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ হবে না।’
জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন অধিকাংশ রোগী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ কারণে সুস্থ হতে সময় লাগছে। চিকিৎসকরা যার দরকার নেই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আবার মৃত্যুর পর বলা হচ্ছে দেরিতে আসার কারণে মৃত্যু ঘটছে। এখানে এর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।’
যারা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ ৬০-এর বেশি, গর্ভবতী নারী এবং শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই তাদের চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে থাকতে হবে, নয়তো তাদের জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে। আর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক পরে দেখা দিয়েছে। এখানেও চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং ম্যানেজমেন্টের কী অবস্থা, সেদিকে নজর দিতে হবে।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস নিয়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কবিরুল বাশার। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখন আর এডিস ঢাকার মশা নয়, পুরো দেশে ছড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে এডিসের ঘনত্ব বাড়ছে।’