শুক্রবার আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে এবং আগামী অন্তত ৫-৭ দিন এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
বিবিসি:
“ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা পর্যন্ত হাঁপাচ্চে, হাঁপাতে হাঁপাতে এ্যামনে অটো মারা যাচ্চে। মুরগির বাচ্চা আমার সামনে মারা গেলো। ইস্টক করে, হাট ইস্টোক (হার্ট স্ট্রোক) করে মনে হয়, যথাসম্ভব।”
দুপুর রোদের উত্তাপের তীব্রতা বর্ণনা করতে গিয়ে এই কথাগুলো বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার দামুরহুদা উপজেলার জিরাট গ্রামের বাসিন্দা শাহানুর ইসলাম।
তিনি বলেন, রোদের তাপমাত্রা এতো বেশি যে, সকাল দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদই ভরদুপুরের উত্তাপ ছড়াতে থাকে রোদ।
“এতো তাপ যে মাঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।” গরমে পশুপাখিদেরও ত্রাহি অবস্থা বলে জানান তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরও বলছে যে, শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। আর এর মাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, টানা প্রায় ১৩ দিন ধরেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙায় রেকর্ড করা হচ্ছে। আর এটি ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর আশপাশেই থাকছে।
এরমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার এবং আজ শুক্রবার এই জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।
কৃষিকাজই শাহানুর ইসলামের জীবিকার উৎস। তিনি জানান, প্রচণ্ড তাপের কারণে পানের বরজের মাথা কালো হয়ে যাচ্ছে। পাটের যে ছোট চারা সেগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। সেচও সেভাবে দেয়া যাচ্ছে না কারণ দিনে দুই তিন বার করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। আর সেচের উপর নির্ভরতা বাড়ায় পানির স্তরও আগের তুলনায় নিচে নেমে গেছে বলে জানান মি. ইসলাম।
শাহানুর ইসলামের মতোই আরেক কৃষক মান্নান মন্ডল। তার বাড়ি একই উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামে। শুক্রবার দুপুরে যখন মান্নান মন্ডলের সাথে কথা হয় তখন তিনি খোলায় ভূট্টা শুকিয়ে নিচ্ছিলেন।
গরমের কথা জিজ্ঞেস করতেই টানা একটা শ্বাস নিয়ে জানালেন “গরমে টেকাটা” মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। সকাল ১০ টার পর রোদের উত্তাপে আর মাঠে থাকা যায় না বলে জানান তিনি।
রোদের উত্তাপ বোঝাতে গিয়ে মি. মন্ডল বলেন, “আগলা গায়ে (খালি গায়ে) তো থাকাই যাবে না এমন তাপমাত্রা, কিন্তু গায়ে জামা থাইকলে ভালো হচ্ছে। খালি গায়ে থেকে মাঠে কাজ করা যাবে না, পিঠে ফোসকা পইরে যাবে।”
মি. মন্ডল বলেন, ক্ষেতের ধানগাছগুলো তাজা রাখতে জমিতে পানি দিয়ে রাখতে হচ্ছে। আর মানুষের খাওয়ার পানি আসছে চাপকল বা গভীর নলকূপ থেকে। তবে সেখানে রোদের তাপে পানি গরম হয়ে গেছে। ঠান্ডা পানি পেতে হলে বেশ কিছুক্ষণ চাপ দিয়ে আগে কিছু পানি ফেলে দিতে হয়। তারপর গিয়ে মেলে ঠান্ডা পানি।
চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার নুরনগর এলাকার বাসিন্দা শামীম সরদার। গাড়ি ধোয়া-মোছা ও মেরামতের ব্যবসা তার। মি. সরদারের সাথে কথা বলার সময় গরম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গায়ে কাপড় রাখা যাচ্ছে না।
“বাড়ি থেকে পাঞ্জাবি পরে আসছিলাম। আপনার সাথে যখন কথা বলছি এর আগ পাঞ্জাবিটা খুলে এখন সেন্টো গেঞ্জি গায়ে ছায়ায় বইসে আছি। গায়ে মনে হচ্ছে ফোসকা পরে যাচ্ছে রোদে দাঁড়ালে পড়ে।”
মি. সরদার বলেন, একে তো গাড়ি ধোয়া-মোছার কাজ কায়িক শ্রমের, তার উপর রোদের তীব্রতার কারণে ঘাম হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। যার কারণে রমজান মাসেও রোজা রাখতে পারছেন না তিনি।
“রোজা রাখলে তো স্যালাইন খেতে পারতাম না। সকাল থেকে তিন-তিনটে স্যালাইন খেয়ে ফেললাম। তারপরও ঘামতেছে গা। সব কিছুই গরম। এতো গরম তো আমি আমার জীবনে চোখে দেখিনি।”
শুক্রবার আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে এবং আগামী অন্তত ৫-৭ দিন এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, সপ্তাহ খানেক পর কিছু কিছু এলাকায় তাপপ্রবাহ কমে যেতে পারে। যেসব এলাকায় তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে সেগুলো হয়তো মৃদু তাপপ্রবাহে নেমে আসতে পারে। তবে সেটাও ২১-২২ তারিখের আগে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
“২১-২২ তারিখ বা তার পরে বাংলাদেশের নর্থ-ইস্টার্ন পার্টে, সিলেট-ময়মনসিংহ এসব অঞ্চলে বৃষ্টি হওয়ার চান্স আছে। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যেতে পারে।”
মি. হক বলেন, মৃদু তাপপ্রবাহ হচ্ছে ৩৬-৩৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাঝারি তাপপ্রবাহ হচ্ছে ৩৮-৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তীব্র তাপপ্রবাহ হচ্ছে ৪০-৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি বা তার উপরে চলে গেলে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
আবহাওয়া যেহেতু প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হয় তাই যেকোন সময় এটি বদলে যেতে পারে উল্লেখ করে মি. হক বলেন, এখনো পর্যন্ত যে তথ্য আছে সে অনুযায়ী, আগামী কয়েক দিন মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বজায় থাকবে। এই সময়ের মধ্যে বৃষ্টিপাতের তেমন কোন সম্ভাবনা নেই।
“হয়তো বা এমন হতে পারে একটা দুটা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বৃষ্টি হতে পারে। তবে এটা একেবারেই এক্সেপশনাল কেস,” বলেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গায় এতো তাপমাত্রা কেন?
চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
বরং এর আগে ২০১৪ সালে এই জেলার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করার কথা জানা যায়।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, বাংলাদেশে এপ্রিল হচ্ছে সর্বোচ্চ গরম মাস। এই সময়ে পৃথিবী সূর্য থেকে রশ্মি বা কিরণ পায় সেটি লম্বালম্বিভাবে পায়।
সূর্যকে কেন্দ্র করে যে কক্ষপথ ধরে পৃথিবী ঘুরছে সেখানে পৃথিবীর অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে কাছ থেকে সূর্যরশ্মি গ্রহণ করছে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশিই পরে এই অঞ্চলে।
তবে চুয়াডাঙ্গায় কেন বেশি তাপমাত্রা থাকে এমন প্রশ্নের উত্তর আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, যশোর, চূয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, খুলনা এই অঞ্চলে বিস্তৃত সমভূমি রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বিশাল এলাকা জুড়ে সমভূমি।
ফলে তাপমাত্রা প্রবাহের যে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে- পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ- এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে।
দ্বিতীয়ত, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দিয়ে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করায় তাপমাত্রা বাড়ে।
আবহাওয়াবিদ মি. হক বলেন, বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমঘাট হচ্ছে খুলনা, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল। আর বঙ্গোপসাগর হচ্ছে জলীয় বাষ্পের উৎস। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে বলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই এলাকায় বেশি থাকে। ফলে তাপমাত্রাও বেশি থাকে।
মি. হক বলেন, “এখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন আমি যদি বাতাসে আরো ২০ শতাংশ জলীয় বাষ্প ঢুকিয়ে দেই তাহলে ওই ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি না থেকে ৪১ বা ৪২ ডিগ্রিতে রূপ নিতে পারে।”
তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সূর্য থেকে চুয়াডাঙ্গার অবস্থান বা সোলার পজিশন।
সূর্যের উত্তরায়নের কারণে তাপমাত্রা বাড়ে।
মি. হক বলেন, পৃথিবী সাড়ে ২৩ ডিগ্রি কোণে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ফলে ২১শে মার্চের পর থেকে ২১শে জুন পর্যন্ত উত্তর মেরুতে সবচেয়ে বেশি সূর্যের তাপ পৌঁছায়। আর বাংলাদেশ যেহেতু ২২ ডিগ্রি থেকে ২৬ডিগ্রি এরকম অবস্থানে আছে এবং কেন্দ্র রয়েছে ২৩ ডিগ্রির কাছাকাছি।
“ফলে সূর্যের যে সর্বোচ্চ কিরণ সেটা কিন্তু পড়ে এই সব অঞ্চলে,” বলেন তিনি।
যার কারণে এই অঞ্চলে তাপমাত্রাটা বেশি থাকে বলেও জানান তিনি।
গরমকালে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকলেও শীতকালে অবশ্য সেটি থাকে না। বরং শীতকালে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসে, চুয়াডাঙ্গা সেসব অঞ্চলের অন্যতম।
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তাপমাত্রা শীতকালে কম থাকার কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, এর জন্য দায়ী আসলে শীতকালে প্রবাহিত শুষ্ক বাতাস।
শীতকালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যে শুষ্ক বাতাস বয়ে যায় তা সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসে।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে এই শুষ্ক বাতাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। হিমালয়ের একপাশ দিয়ে শুষ্ক বাতাস ঢুকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা- এসব অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে।
আর দ্বিতীয়টি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে।
এই দুটি বায়ু-প্রবাহের মধ্যে যেটি বেশি সক্রিয় বা শক্তিশালী থাকে সেবছর ওই অঞ্চলে বেশি শীত অনুভূত হয়।