Home বিনোদন দিব্যা ভারতী কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন?

দিব্যা ভারতী কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন?

দিব্যা ভারতী

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বলিউডের জগতে স্বনামধন্য অভিনেত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন দিব্যা ভারতী। অত্যন্ত সুন্দরী ও আবেদনময়ী হিসেবে তাঁর বিশেষ একটু খ্যাতিও ছিল। ‘দিওয়ানা’, ‘শোলা অর শবনম’-এর মতো সব জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘দিওয়ানা’তে শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় তাঁর কেরিয়ারের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কেরিয়ারের শুরুতেই এমন একজন উঠতি অভিনেত্রীর পথচলা থেমে যায় চিরতরে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচতলা থেকে নিচে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। আপাতদৃষ্টিতে দুর্ঘটনা মনে হলেও অনেকেই একে নিছক দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ ছিলেন। ফলত দিব্যা ভারতী মৃত্যুরহস্য ঘিরে ঘনিয়ে ওঠে জল্পনা-কল্পনা, উঠে আসে নানারকম তত্ত্ব। মাত্র ১৯ বছর বয়সে জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর আকস্মিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বলিউডকে।

১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল রাতে ঘটে যায় এই দুর্ঘটনা, পাঁচতলার উপর থেকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দার গ্রীলহীন খোলা জানালা থেকে একেবারে নিচে পড়ে যান দিব্যা ভারতী। রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসা-সাহায্য যখন এসে পৌঁছেছিল তখনও তাঁর শ্বাস চলছিল, কিন্তু মারাত্মক শারীরিক আঘাতের ফলে তিনি খুবই অল্প সময় বেঁচেছিলেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সেদিন অর্থাৎ ৫ এপ্রিল দিব্যা ভারতী চেন্নাই থেকে একটি শ্যুটিং শেষে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর হায়দ্রাবাদ যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটি বাতিল হয়ে যায় ফলে, চেন্নাই থেকে ফিরে এসে তিনি সেদিন তাঁর আসন্ন নতুন প্রজেক্ট ‘আন্দোলন’-এর জন্য ফ্যাশন ডিজাইনার নীতা লুল্লা এবং তাঁর স্বামী শ্যাম লুল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার পরিকল্পনা করেছিলেন। নীতা এবং সুনীল দুজনেই চলে এসেছিলেন মুম্বাইয়ের পশ্চিম আন্ধেরির ভেরসোভাতে অবস্থিত তুলসী বিল্ডিং-এ দিব্যা ভারতীর অ্যাপার্টমেন্ট। সেদিন রাতে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল মদ্যপানও। ভারতীর পরিচারিকা অমৃতা কুমারীও তখন ছিলেন সেখানে এবং অতিথিদের জন্য তিনি স্ন্যাকস ভাজছিলেন এবং পরিবেশন করছিলেন। কথা বলার মাঝখানে দিব্যা উঠে গিয়েছিলেন বারান্দার দিকে, সেখানে এক খোলা জানালার ওপরে বসেছিলেন তিনি। ওদিকে নীতা এবং শ্যাম লুল্লা তখন টেলিভিশনের পর্দায় কোন এক অনুষ্ঠান দেখায় মশগুল হয়ে পড়েছিলেন। ওই খোলা, গ্রীলহীন জানালা থেকেই ভারসাম্য হারিয়ে আচমকা পড়ে গিয়েছিলেন দিব্যা ভারতী। অ্যাম্বুলেন্স আসবার পরেও কিছুক্ষণ শ্বাস চলছিল তাঁর, হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু অত উঁচু থেকে একেবারে বাঁধানো শক্ত মাটির ওপরে পড়বার ফলে ভয়ানক শারীরিক আঘাতের কারণে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

এমন একজন উঠতি অভিনেত্রীর এমন আকস্মিক মৃত্যুতে সমগ্র বলিউড এবং সাধারণ মানুষও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। দিব্যা ভারতীর ওই জানালা থেকে পড়ে যাওয়াকে ঘিরে এরপর চলতে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা – ঘনীভূত হয় দিব্যা ভারতী মৃত্যুরহস্য। যেহেতু ফ্ল্যাটে তখন তিনি ছাড়া আরও তিনজন উপস্থিত ছিলেন, সেহেতু অনেকেই এই মৃত্যুর পিছনে হত্যার ষড়যন্ত্র খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ আবার হতাশাজনিত কারণে আত্মহত্যা বলেও মনে করেছেন এই মৃত্যুকে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দিব্যা ভারতী মৃত্যুরহস্য নিয়ে ট্রয় রিবেইরো একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ট্রয় ঘটনাস্থলে থাকা মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন তথ্য কিছু প্রকাশ করেছিলেন। ট্রয়ের গ্রন্থ অনুযায়ী, দিব্যা সম্ভবত মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে যে তিনি মদ্যপান করেছিলেন তা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। দিব্যা নিজের মদভর্তি গ্লাস নিয়েই নাকি বারান্দায় গিয়েছিলেন এবং একা একা বসেছিলেন। দিব্যার পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে সবাই ছুটে গিয়েছিল এবং তাঁর অতিথিরাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

ট্রয়ের লেখা থেকে আরেকটি চাঞ্চল্যকর যে তথ্য জানা যায়, তা হল, দিব্যার বাবা ও ভাই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন এবং তাঁর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন আমার মেয়েকে ওরা মেরে ফেলল। এই মন্তব্যে আদতে কার বা কাদের দিকে তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন, সেবিষয়টি রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দিব্যা ভারতী বিবাহ করেছিলেন প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াদওয়ালাকে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাঁর নতুন নাম হয়েছিল সানা নাদিয়াদওয়ালা। যদিও তাঁর অভিনয় কেরিয়ারে যাতে কোন প্রভাব না পড়ে সেই কারণে বিবাহের কথা তিনি গোপন করে রেখেছিলেন। স্ত্রী-এর মৃতদেহ দেখে সাজিদ হতাশায় ভেঙে পড়েন এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি, ফলে তাঁকে আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়েছিল।

৫ এপ্রিল রাতে দিব্যার ফ্ল্যাটে উপস্থিত নীতা লুল্লাকে পুলিশ যখন ঘটনাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তখন তিনি জানান এতই আকস্মিকভাবে এটি ঘটেছিল যে তিনি স্পষ্ট করে জানেন না যে এটি আত্মহত্যা নাকি কোন দুর্ঘটনা।

দিব্যার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুলিশকে জানায় যে, দিব্যা সেদিন বিষন্ন ছিলেন বলেই নাকি তাঁর হায়দ্রাবাদের শ্যুটিংটি বাতিল করে দিয়েছিলেন। সাজিদ এবং তাঁর নতুন বাড়ির জন্য কিছু সরঞ্জাম কিনতে গেছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়। তারপর নাকি এক বন্ধুর বাড়ির পার্টিতে গিয়েছিলেন দিব্যা। মদ্যপ অবস্থায় ফিরে আসার পর সেদিন সাজিদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল দিব্যার এবং সাজিদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কিছু ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে দেখা করতে। দিব্যা নাকি তখন স্বামীকে এও বলেছিলেন যে, ১০ মিনিটের মধ্যে সাজিদ ঘরে না ঢুকলে দিব্যাকে সে আর দেখতে পাবে না। যদিও এই কথায় সাজিদ নাকি পাত্তা দেননি। নীতা তখন দিব্যার ফ্ল্যাটেই ছিলেন। দিব্যা তখন তাঁর বারান্দার খোলা জানালায় গিয়ে বসেন এবং নীতা তাঁকে ভিতরে চলে আসতে বললেও তিনি আসেন না, এমনকি আত্মহত্যার হুমকি পর্যন্ত দিতে থাকেন। নীতা এরপর তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে দিব্যা জানালা দিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়েছিলেন৷ পুলিশের কাছে দেওয়া নীতার পূর্বোক্ত বয়ান এবং এই তথ্যটি পাশাপাশি রাখলে কেসটি জটিল হয়ে ওঠে ক্রমশ।

দিব্যার এক প্রতিবেশীর বয়ানে আবার নতুন একটি দিক উঠে আসে। সাজিদের সঙ্গে ঝামেলার পর নাকি দিব্যা অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিলেন। সাজিদ নাকি এই কান্ডে ভয় পেয়ে গিয়ে তাঁদের প্রতিবেশী নীতা লুল্লা ও তাঁর স্বামীকে ডেকে আনেন। তাঁরা এসে দিব্যার ভাই আর সাজিদকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। এই বয়ান অনুযায়ী দিব্যার ভাই তখন বাড়িতেই ছিলেন। নীতা এবং তাঁর স্বামী দিব্যার সঙ্গে কথা বলবার জন্য ভেতরে যান এবং পরিচারিকাকে থাকতে বলা হয়। তখন রান্নাঘরে লুকিয়ে নাকি দিব্যা বেশ কিছুটা মদ্যপান করে সকলের অলক্ষ্যেই বারান্দায় গিয়ে এই বিভৎস কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন৷ ট্রয় কিন্তু এই পরিচারিকাকেও তাই সন্দেহের বাইরে রাখেননি যদিও তাঁর আক্ষেপ ছিল যে, পুলিশ এই পরিচারিকাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। অন্য এক সূত্র অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পর নীতা এবং দিব্যার পরিচারিকা অমৃতা দিব্যার বাড়িতে তাঁর মা-বাবা এবং ভাইকে খবর দিতে গিয়েছিলেন। একথা সত্যি হলে বুঝতে হবে সেদিন দিব্যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর ভাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে যে, ঘটনার দিন রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত দিব্যার মায়ের দেখা পাওয়া যায়নি। প্রায় ৩.৪৫ নাগাদ তিনি হাসপাতালে আসেন এবং মেয়ের মৃত্যুর কথা তিনি বিশ্বাস করতেই চাইছিলেন না। তবে হঠাৎ দিব্যার বাবা এবং ভাই তাঁর মাকেই এই মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করতে থাকেন।

সেদিন রাতের ঘটনা পরম্পরাটি কেমন ছিল তা নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কোনটি সঠিক আর কোনটি নয়, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর ধন্দ। তবে দিব্যার মানসিক সমস্যার কথা বেশিরভাগ তত্ত্বেই উঠে আসে। নীতার স্বামী সুনীল, যিনি কিনা পেশায় ছিলেন একজন মনোবিদ, বলা হয় দিব্যা হয়তো তাঁর চিকিৎসাধীন ছিলেন। এমনকি এমন তথ্যও উঠে আসে যে, দিব্যা ভারতীর মধ্যে নাকি একরকম আত্মহননের প্রবণতা ছিল। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে কোন কারনে বিরক্ত হয়ে গিয়ে তিনি নাকি একটা সিগারেটের খোসায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও ‘রাধা কা সঙ্গম’-এর সময় হতাশ হয়ে নিজের কব্জি কেটে রক্তপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি। এইরকম প্রবণতা হতাশা থেকে আত্মহত্যার যে তত্ত্ব সেটিকে জোরালো করে তুলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দিব্যার বাবা নিজেই একটি বিবৃতি দিয়ে তাঁর মেয়ের হতাশাগ্রস্ততা এবং আত্মহত্যার তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আত্মহত্যা বা হত্যার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ কোনরকমভাবেই দিব্যা বিষণ্ণ ছিলেন না। সে মদ্যপান করেছিল ঠিকই কিন্তু মাত্র আধঘন্টায় আর কতখানিই বা মদ্যপান করা যায়! তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল, এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা। সেদিন দুর্ভাগ্যক্রমে নীচে যেসব গাড়ি পার্ক করা থাকে তার একটাও ছিল না, ফলে সরাসরি দিব্যা মাটিতে পড়েছিল। একটা সময় পর এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবেই ঘোষণা করে কেসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

দিব্যার বাবা স্বয়ং এমন একটি মন্তব্য করে কেসটিকে একটি সরল অভিমুখ দিলেও কিন্তু নানারকম বয়ান ও তত্ত্বের কারণে দিব্যা ভারতীর মৃত্যরহস্য আজও রহস্য হয়েই থেকে গেছে।

সূত্র: সববাংলায়.কম