অমিতাভ রায়
দিল্লি: উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে দিল্লিতে একটি বাংলা স্কুল স্থাপিত হয়। কেন? তখনও তো ১৯০৫-এর বঙ্গ বিভাজন হয়নি। ভাঙা বাংলা জোড়া লাগানোর ফল হিসেবে নেওয়া হয়নি দেশের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত? সেসব তো অনেক দূর মানে ১৯১১-র বিষয়। স্বয়ং জর্জ নাথনিয়েল কার্জন (লর্ড কার্জন) সবেমাত্র ভারতবর্ষের ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন (৬ জানুয়ারি, ১৮৯৯)। তবুও কী কারণে যেন ১৮৯৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থাপিত হল দিল্লির প্রথম বাংলা স্কুল। ঠিকানা : দারিবা কালান (কাটরা মাশরুত)।
চাঁদনী চকের দারিবা কালান অবিশ্যি এখন জিলিপি আর রাবড়ি-র জন্য সুপরিচিত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা অর্থাৎ সারা বছরই এখানকার একটি দোকানে ভোররাত থেকে মাঝরাত পর্যন্ত লোকে লাইন দিয়ে গরম গরম জিলিপি কেনে। এবং দাম বাজারদরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সেই দারিবা কালানের এক ভাড়াবাড়িতে স্থাপিত হয় দিল্লির প্রথম বাংলা স্কুল।
মাত্র চল্লিশ জন ছাত্র। মাস্টারমশাই নারায়ণ দাস। সকালে ঘণ্টা দুয়েক ক্লাস চলে। তার বেশি কী করে হবে? নারায়ণবাবুকে তো তারপর চাকরি করতে ছুটতে হবে। চাঁদনী চকের কার্টারক কোম্পানি তাঁর কর্মস্থল। স্কুলের ছাত্র পড়ানো পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রম। পরের বছর অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরে স্কুলে যোগ দিলেন পণ্ডিত নেত রাম। মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় তাঁর বেশ ভাল দখল। ১৯৩০ পর্যন্ত তিনি এখানে পড়িয়েছেন। পণ্ডিতজি আসার কিছুদিন বাদেই এই স্কুলে ইংরেজি পড়াতে এলেন মিস্টার পিয়ারসন নামের জনৈক ব্রিটিশ মাস্টারমশাই। ১৯৩৩ পর্যন্ত তিনি এখানে ইংরেজি পড়িয়েছেন।
ততদিনে বেশ কয়েকবার স্কুলের ঠিকানা পাল্টিয়েছে। দারিবা কালানের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানা হল চাঁদনী চকের এসপ্ল্যানেড এলাকার সত্যনারায়ণ মন্দিরের পাশের বাড়ি। তারপর হ্যামিল্টন রোড। তারপরেও আবার বদল। ১৯২১ থেকে কাশ্মীরি গেট এলাকার সেন্ট জেমস্ চার্চের কাছে অবস্থিত চার্চ রোড। এখানে অবিশ্যি নয় নয় করে চল্লিশ বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৯৬১ থেকে সিভিল লাইনসের আলিপুর রোড (শাম নাথ মার্গ) হয়ে গেল দিল্লির প্রথম বাংলা স্কুলের স্থায়ী ঠিকানা। সরকারি নাম বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল। আর লোকের মুখে, কাশ্মীরি গেট বেঙ্গলি স্কুল।
ডাক ও তার বিভাগের তরফে ১৯০১ নাগাদ স্কুলটির জন্য ৫০ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। সম্ভাব্য কারণ, সরকারের ওই বিভাগের কর্মচারীদের বাড়ির ছেলেরা ছিল এই স্কুলের ছাত্র। তখনকার রীতি অনুযায়ী এই স্কুলটি ছিল পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রাপ্ত। ১৯৩৬-এ দিল্লি শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হওয়া পর্যন্ত দশ ক্লাসের পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে গেছে। ১৯৪৯-এ কাশ্মীরি গেটের বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে ছাত্রীরা প্রবেশাধিকার পায়।
দেশের রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় সরকারি দপ্তর স্থানান্তরের কাজ।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের আগমনে ভাল করে গড়ে ওঠার আগেই নতুন দিল্লি রীতিমতো জমজমাট। সিভিল লাইনসের দপ্তরগুলির আশপাশের এলাকায় নবাগতদের বসবাস। প্রাথমিক পর্যায়ে তিমারপুর কাশ্মীরি গেট এলাকায় অনেকে বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে পেরেছিলেন। এদিকে রাইসিনা হিলস্ কনট প্লেস্ ইত্যাদি এলাকাকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় আস্তে-ধীরে সরকারি আবাসন গড়ে উঠছে। প্রথমে একা এলেও আবাসনের সুযোগ পাওয়ামাত্রই সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই কলকাতার পাট তুলে দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে থিতু হওয়া শুরু করলেন।
নয়া বসতে বাজার হাট হাসপাতাল স্কুল কলেজ প্রভৃতির প্রয়োজন। নির্মীয়মাণ শহরে কোথায় স্কুল কোথায় কলেজ! বাড়ির ছেলেদের তো আর লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া যায় না। কলকাতা থেকে আসা সরকারের বাঙালি কর্মচারীদের কাছে এ এক চিন্তার বিষয়।
অবশেষে ১৯২২ নাগাদ গোকুল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একদল বাঙালি বিষয়টি নিয়ে সরকারি স্তরে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। সরকারের আধিকারিকদের বোঝাতে হল কেন বাংলা মাধ্যমের স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এবং তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অবশেষে সরকারের সম্মতি পাওয়া গেল। রাইসিনা হিলসের আশপাশের আবাসনের বাসিন্দাদের নিয়ে ১৯২৫-এর ২৮ ডিসেম্বর স্কুলের ব্যাপারে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সেই বৈঠকেই গঠিত হল প্রস্তাবিত স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই যাত্রা শুরু করল রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল।
তখনকার উইলিংডন বা এখনকার রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের আঙিনায় রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের জন্ম হলেও কিছুদিনের মধ্যেই ঠিকানা পাল্টাতে হয়। হাসপাতাল সম্প্রসারিত হতে থাকে। আবার হাসপাতালের মধ্যে স্কুলের ছাত্রদের নিয়মিত আসাযাওয়া মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। কাছাকাছির মধ্যে ডক্টরস্ লেনে একটা ভাড়াবাড়ি পাওয়া গেল। কাজ চালিয়ে যাওয়া গেলেও যথেষ্ট নয়। সেই সময় রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন রমেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ১৯২৭ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। উদ্যমী মানুষ। কাছাকাছির মধ্যে লেডি হার্ডিঞ্জ রোডের একটা বাংলো পাওয়া যাওয়ায় সাময়িকভাবে স্থানসমস্যার সমাধান হল। তবে রমেশচন্দ্র সেনগুপ্তের নিরলস প্রচেষ্টায় নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কমিটির (এনডিএমসি) কাছ থেকে রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল পেল স্থায়ী ঠিকানা। এনডিএমসি বিনা ভাড়ায় গোল মার্কেট এলাকার মন্দির মার্গে অবস্থিত একটি বাড়ি ও লাগোয়া জমি রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের হাতে তুলে দিল। ১৯৩২-এর ২২ সেপ্টেম্বর এই নির্দেশনামায় সরকারের সিলমোহর পড়ে। রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল আজও সেই ঠিকানায় অবস্থিত।
১৯৮৫-তে সম্প্রসারিত হল রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল। মূল প্রাঙ্গণে নয়, বরং অনেক দূরে শহরের অন্য প্রান্তে অবস্থিত চিত্তরঞ্জন পার্কে স্থাপিত রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলে এখন হাজার দেড়েক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল, চিত্তরঞ্জন পার্ক ১৯৮৮-তে সরকারি অনুমোদন পায়।
১৮৮৭-তে শিমলা-য় স্থাপিত হয়েছিল বেঙ্গলি বয়েজ্ হাইস্কুল। দেশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শিমলায় ১৯৩৪-এর ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক সভায় স্থির হল যে দিল্লিতেও একটা নতুন বয়েজ্ হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভারত সরকারের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। ফলে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৩৯-এর ১৩ ডিসেম্বর ইউনিয়ন অ্যাকাডেমির উদ্বোধন হয়। ঠিকানা : রাজাবাজার, নতুন দিল্লি। কোথায়? কনট প্লেস থেকে শহিদ ভগৎ সিং মার্গ ধরে গোল মার্কেট যাওয়ার পথে বাঁ দিকে শিবাজী স্টেডিয়ামের পাশে অবস্থিত ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল। ১৯৪১ থেকে স্কুলটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭৭-এ বারো ক্লাসের স্কুল শিক্ষা প্রবর্তন হলে ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি হয়ে যায় ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল।
মনিকা সেন একসময় শিক্ষকতা করতেন। বাংলা ভাষা সংস্কৃতি সাহিত্য ইত্যাদির প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৫২-র ১১ নভেম্বর ৬ জন ছাত্রকে নিয়ে নিজের আবাসনেই একটি স্কুলের গোড়াপত্তন করে ফেললেন। সেদিনের সেই এক কামরার শিক্ষায়তন এখন বিনয় নগর বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল নামে সুপরিচিত। ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকায় দরকার হল বড় জায়গা। সরকারি আবাসন পরিপূর্ণ সরোজিনী নগর, বিনয় নগর, লক্ষীবাই নগর এলাকায় জমি পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ এবং কঠোর পরিশ্রম যে কোনও কঠিন কাজকেও সফল করতে পারে। সরকারের কাছ থেকে জমি পাওয়ার পর দরকার হল বাড়ি তৈরির টাকা। প্রথম দিকে টাকার অভাবে নতুন জমিতে তাঁবু খাটিয়ে চলল লেখাপড়ার কাজ। তারপর আস্তে-ধীরে তৈরি হল নিজস্ব বাড়ি। ফলাফল : বারোশোর বেশি ছাত্রছাত্রীর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় আজকের বিনয় নগর বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল।
মোতি বাগে অবস্থিত বিধানচন্দ্র বিদ্যালয় ১৯৬২-র ১ জুলাই স্থাপিত হয়। ঠিকানা : জে ব্লক, শান্তিপথ, চাণক্যপুরী। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভারতরত্ন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে সম্মান জানানোর জন্য তাঁর জন্মদিনকেই স্কুলের উদ্বোধনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্য সমাপতন! ওইদিনই মানে ১৯৬২-র ১ জুলাই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল। তাঁবুতে ক্লাস হত। ছাত্র জনা পঞ্চাশ। সেদিনের সেই ছোট্ট বিদ্যায়তন আজ তিনতলা অট্টালিকায় এক হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন মানবিক বিদ্যা (humanities), বাণিজ্য (commerce), এবং বিজ্ঞান (science) বিভাগে পড়াশোনা করা যায়।
লোদী রোড এলাকার সরকারি আবাসনে প্রথম থেকেই প্রচুর বাঙালি কর্মচারীর বসবাস। দেশভাগের পর লোদী কলোনিতে দোকান বাজার গড়ে উঠলেও স্কুলের অভাব। সরকারের কর্মচারীরা উদ্যোগ নিলেন। ১৯৪৮-এ ১৭-এ লোদী এস্টেট ঠিকানায় গড়ে উঠল শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যালয়। প্রথম পর্যায়ে মাধ্যমিক হলেও এখন উচ্চমাধ্যমিক।
দিল্লির বাংলা স্কুলগুলি বাঙালির উদ্যোগে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনার জন্য গড়ে উঠেছিল। তবে সময়ের তাগিদে সবগুলি স্কুলেই এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়।