হবিগঞ্জ থেকে মাসুদ লস্কর: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার ৩৬টি চা বাগানের অর্ধ লক্ষ নারী চা শ্রমিক জানেই না এই দিবসের কথা। চা বাগানের সিংহভাগ চা শ্রমিক নারী।
অথচ এই দিনটিতে নারী শ্রমিকদের কোনো ছুটি দেওয়া তো দূরের কথা সেখানে দিবসটি পালনেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
চা শ্রমিকদের অধিকান নিয়ে কাজ করা মোহন রবি দাস জানান, এ দেশের অন্যান্য শ্রমজীবী নারীদের তুলনায় চা-বাগানের নারী চা-শ্রমিকদের জীবনধারা ও কাজের ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। চৌকিদারের ডাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক সব কাজকাম করে সকাল ৮টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। স্থানভেদে ৪-৫ মাইল পায়ে হেঁটে তারপর কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। সাধারণত চা পাতা তোলা ও চা গাছ ছাঁটাই করা দুটি কাজ-ই নারী চা- শ্রমিকরা করে থাকেন। যা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। কেননা অনেক উঁচু উঁচু টিলা (ছোট পাহাড়) বেঁয়ে তাদেরকে চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়।
এছাড়া যেহেতু চা গাছকে ঘিরে গভীর জঙ্গল বা আগাছা থাকে তাই সেখানে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিচ্ছু, গজর (শুঁয়োপোকা), হাড়ি বরল (এক ধরনের বিষাক্ত মাছি যা চা গাছের ডালে মাটির হাড়ি বানিয়ে বাস করে), বিষাক্ত পিঁপড়া ইত্যাদির অবাধ বিচরণ। তারা এগুলোর কামড় খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই এগুলোকে বিষাক্ত বলে মনে করে না। মাত্র ১২০ টাকার বিনিময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি তাদেরকে কাজ করতে হয়।
এর মধ্যে তারা দুপুর ২টার সময় মাত্র আধা ঘণ্টা সময় পায় দুপুরের খাবারের জন্য। তখন বাড়ি থেকে আনা রুটি এবং তার সঙ্গে মরিচ, পেঁয়াজ, আলু ও কচি চা পাতা মিশিয়ে বিশেষ এক ধরনের চাটনি তৈরি করে দুপুরের খাবার সেরে ফেলে। কেউবা চাল ভাজা ও লাল চা দিয়েই সাঙ্গ করেন দুপুরের খাবার। তারপর আবার শুরু কাজ। তারপর আবার বাড়ির কাজ করতে হয় এবং পর দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা। এভাবেই শত কষ্টের মধ্যে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এই মহীয়সী নারীরা এক বিরাট ভূমিকা পালন করছেন, কিন্তু এদের ভাগ্যের উন্নতির জন্য সরকারপক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, চা-বাগানে ছুটি ঘোষণা করে নারী দিবস বিশেষভাবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি চা শ্রমিক নারীদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য উপজেলা ও জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর সর্বোপরি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দারাগাঁও চা বাগানের নারী শ্রমিক মিনা সাঁওতাল বলেন, ‘আমরা দিবস টিবস কিছু বুঝি না। কাজ ছাড়া আর কিছু জেনে বুঝেও লাভ নেই’।
একই বাগানের নারী চা শ্রমিক মিনতি বারাইক বলেন‘ নারী দিবসের কথা জানি না। আমাদেরকে যে কষ্ট করতে হয় এই কথা কাউকে বলতে পারি না। কাজের বাহিরে আমাদের কোনো কিছু চিন্তা করার সময় ও সুযোগও থাকে না।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা বাগানের শ্রমিক নিপেন পাল বলেন, চা শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। তারা দিনরাত কষ্ট করে। কিন্তু তাদের অধিকারের বিষয়ে তারা নিজেই জানে না। সরকারের উচিৎ চা শ্রমিক নারীদের এ বিষয়ে সচেতন করা।