বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
সাফ নারী ফুটবলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সোমবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এ বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে বাংলাদেশি নারীরা। দশরথ স্টেডিয়ামের এ জয় বাংলাদেশে ফুটবলের অন্যতম বড় সাফল্য নিঃসন্দেহে। এর আগে নেপালের বিপক্ষে একবারও জিততে না পারা নারী দল সঠিক সময়ে জ্বলে উঠে দেশকে এনে দিয়েছে অবিশ^াস্য সাফল্য। যে সাফল্যকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের মেয়েদের এভারেস্ট জয়।
ফাইনালের আগে কোন দিক থেকেই এগিয়ে ছিল না বাংলাদেশ দল। ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৪৫ ধাপ আগে ছিল নেপাল। নিজেদের মাঠে খেলা হওয়ায় গ্যালারি ভর্তি দর্শকরা গলা ফাটিয়ে সমর্থন জুগিয়েছে স্বাগতিকদের। বৃষ্টির কারণে মাঠ ভেজা থাকায় বলও ঠিকমতো পাস দেয়া যাচ্ছিল না। সব মিলিয়ে এভারেস্টসম প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়তে হয়েছে সাবিনাদের।
গ্রুপপর্বে এবং সেমিফাইনালে দাপটের সঙ্গে খেলা বাংলাদেশের নারীরা ফাইনালে খেলেছে পরিকল্পিত ফুটবল। কোচ ছোটন ভালভাবেই জানতেন স্ট্যামিনায় নেপালের মেয়েরা কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে। তাই খেলতে হবে কৌশলী ফুটবল। কোচ কৌশল পুরোপুরি কাজে লেগেছে। বল দখলের হিসেবে হয়তো নেপাল কিছুটা এগিয়েছিল, কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের নারীরাই। আক্রমণে গিয়েছে সবাই মিলে আবার রক্ষণভাগও সামলেছে সবাই মিলে। গোলরক্ষক রূপনা চাকমা থেকে শুরু করে আক্রমণভাগের কৃষ্ণা, সামসুন্নাহার, খেলেছেন নিরলস ফুটবল।
যে কোন ম্যাচে জিততে হলে দরকার প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগানো। আর সেটা করতে পারার কারণেই জিততে পেরেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, ১৩ মিনিটে করা প্রথম গোলই ম্যাচের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারণ করে দেয়। সে গোলটিই এনে দেয় আত্মবিশ^াস। মনিকা চাকমার ক্রসে সামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে ফ্লিক করে প্রথম গোলটি করেছেন তা ছিল এক কথায় অসাধারণ। দু’জন ডিফেন্ডারের মাঝখান থেকে এভাবে ফ্লিক করে গোল করতে পারেন বিশ^ ফুটবলের খুব কমসংখ্যক ফুটবলারই।
প্রথম গোল বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কিছুটা রক্ষণাত্মক খেলতে উৎসাহিত করে। এ সুযোগে নেপাল ম্যাচে প্রাধান্য স্থাপন করে। তবে আঁখির নেতৃত্বাধীন রক্ষণভাগ ছিল অবিচল। প্রতিপক্ষকে তারা তেমন কোন সুযোগই দেয়নি। দুই-একবার নেপালিরা সুযোগ পেলেও সেগুলো রুখে দিয়েছেন গোলরক্ষক রূপনা।
বাংলাদেশ প্রথমার্ধের খেলার চার মিনিট বাকি থাকা অবস্থায় করে দ্বিতীয় গোল। কাউন্টার অ্যাটাক থেকে গোলটি করেন কৃষ্ণা রানী। অধিনায়ক সাবিনার ডিফেন্স চেরা পাস নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্লেসিং শটে পরাস্ত করেন গোলরক্ষক আনজিলাকে। বাংলাদেশের দু’ গোলের মাঝখানে অন্তত দু’বার গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল নেপাল। একবার গোললাইন থেকে বল ক্লিয়ার করেন ডিফেন্ডাররা। আরেকবার পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে দীপা শাহির নেয়া শট ঝাপিয়ে রুখে দেন রূপনা।
২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতির পর খেলতে নেমে কিছুটা রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশ দল। যে সুযোগে একের পর এক আক্রমণ করে বাংলাদেশকে বেশ চাপের মধ্যে ফেলে দেয় নেপালি নারীরা। একের পর এক আক্রমণ করে তারা ৬৯ মিনিটে একটি গোল আদায় করে নেয়। ডিফেন্ডার শামসুন্নাহার সিনিয়র ঠিক জায়গায় না থাকায় ফাকায় বল পেয়ে যান অনিতা এবং তিনি বল জালে পাঠিয়ে নেপালি সমর্থকদের কিছুটা আনন্দ করার সুযোগ দেন। তখন বাংলাদেশ দল ২-১ গোলে এগিয়ে থাকলেও নেপাল মাঠে প্রাধান্য বিস্তার করে খেলছিল। তবে খেলা শেষ হওয়ার ১৩ মিনিট বাকি থাকতে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে কৃষ্ণা দলের তৃতীয় গোল করলে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
নেপালিরা বাকি সময় চেষ্টা করেও আর কোন গোল করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশ জয়ী হয় ৩-১ গোলে এবং নেপালে রচিত হয় বাংলাদেশের নারী ফুটবলের নতুন ইতিহাস।
২০১৬ সালে শিলিগুঁড়ির ফাইনালে স্বাগতিক ভারতের কাছে হেরে স্বপ্ন ভেঙেছিল বাংলাদেশের। এবার কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন মরিয়া ছিলেন লক্ষ্য পূরণে। নেপালের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে তা পূরণ করেই ছাড়ল বাংলাদেশ।
এ নিয়ে পাঁচবার মেয়েদের সাফের ফাইনালে হারের তেতো স্বাদ পেল নেপাল।
১৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দশরথের গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, নেপালি সমর্থকদের আধিপত্য ছিল। নেপালে থাকা ফুটবলপাগল বাংলাদেশিরা সংখ্যায় অল্প হলেও এসেছিলেন সাবিনা-কৃষ্ণাদের জন্য গলা ফাটাতে।
নেপালের বিপক্ষে আগের ৮ দেখায় বাংলাদেশের হার ছিল ৬টি, ড্র দুটি। সাফের সবশেষ দেখায় ২০১৯ সালে বিরাটনগরে সেমিফাইনালে স্বাগতিকদের দল হেরেছিল ৩-০ গোলে। গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালে এসে খেলা দুই ম্যাচের একটিতে ২-১ ব্যবধানের হার, অন্যটি গোলশূন্য ড্র।
ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দু’য়েক আগে ভারী বৃষ্টিতে মাঠ হয়ে যায় কর্দমাক্ত, ভারী।
ম্যাচ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের কৃষ্ণা রানী সরকার।
বাংলাদেশ দল : রূপনা চাকমা, শিউলী আজিম, সামসুন্নাহার, আঁখি খাতুন, মসুরা পারভিন, মনিকা চাকমা, সানজিদা আক্তার (ঋতুপর্না চাকমা), মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণা রানী সরকার, সিরাত জাহান স্বপ্না (সামসুন্নাহার জুনি) ও সাবিনা খাতুন।