ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল মহিলারা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে নেলী সেনগুপ্ত (Nellie Sengupta) অন্যতম। জন্মসূত্রে বিদেশিনী হয়েও তিনি স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজ করেছিলেন। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। কল্পনা দত্তের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেছিলেন নেলী সেনগুপ্ত। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতায় দেশপ্রিয় পার্কের ভিতরে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের পাশে তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।
১৮৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে নেলী সেনগুপ্তর জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম এডিথ অ্যালেন গ্রে। তাঁর বাবার নাম ফ্রেডরিক উইলিয়াম গ্রে এবং মায়ের নাম এডিথ হেনরিয়েটা গ্রে। তাঁর বাবা কেমব্রিজের একটি ক্লাবে কাজ করতেন। নেলী সেনগুপ্ত তাঁর মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন। তাঁর স্বামী বিখ্যাত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কেমব্রিজের ডাউন কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময়েই তাঁর সঙ্গে নেলী সেনগুপ্তের পরিচয় হয়। নেলীর বাবা-মায়ের বাড়িতে প্রায়শই যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত যেতেন, সেখানেই তাদের মধ্যে এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে এই সম্পর্ক নেলীর বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি। বাবা মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন নেলী। বিবাহের পর ১৯০৯ সালে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। তাঁদের দুই ছেলের নাম যথাক্রমে শিশির এবং অনিল।
নেলী সেনগুপ্ত ইংল্যান্ডের কেমব্রিজেই পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি সিনিয়ার কেমব্রিজ পর্যন্তই পড়াশোনা করেছিলেন বলে জানা যায়। কিছু কারণের জন্য তিনি আর কলেজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। ফলে বাকি শিক্ষাচর্চা বাড়িতে থেকেই করেছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুন নেলী সেনগুপ্তও এই সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯২১ সালে নেলী সেনগুপ্ত গান্ধীজী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এরপর আসাম বেঙ্গল রেলওয়েম্যানদের ধর্মঘটের সময় যতীন্দ্রমোহন কারারুদ্ধ হন এবং নেলী এই ঘটনার বিরুদ্ধাচরণ করেন। নেলী সেনগুপ্ত জেলা কর্তৃপক্ষের সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি গণসভায় ভাষণ দেন এবং গ্রেপ্তারীর বিচারের জন্য আদালতে যান। তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে নিজের হাতে বানানো খাদি কাপড় মানুষের কাছে বিক্রি করতেন। ১৯৩১ সালে বে-আইনি সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য তিনি দিল্লিতে চার মাসের জন্য কারারুদ্ধ ছিলেন। এই চার মাস জেলে থাকাকালীন তিনি জেলটিকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর বলে পরিচয় দেন। ১৯৩৩ সালে রাঁচির জেলে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর মৃত্যু ঘটে, এই সময় নেলী তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। অনেকেই ভেবেছিল, স্বামীর মৃত্যুর পরে নেলী স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে সরে আসবেন, কিন্তু তা ঘটেনি। তিনি স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নিয়ে দেশের মানুষকে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের জন্য অনুরোধ জানান। লবণ সত্যাগ্রহ চলাকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (INC) তৎকালীন সভাপতি পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য সহ আরও অনেক নেতা কারারুদ্ধ হলে, সেই সময় নেলী সেনগুপ্তর কাঁধে বেশ বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়ে। ১৯৩৩ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতার ৪৮তম বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি হন তিনি। এর ফলে তিনি হয়ে ওঠেন তৃতীয় মহিলা এবং দ্বিতীয় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত মহিলা কংগ্রেস সভাপতি। ১৯৩৩ এবং ১৯৩৬ সালে নেলী সেনগুপ্ত কলকাতা কর্পোরেশনের একজন অল্ডারম্যান ছিলেন। পরে ১৯৪০ এবং ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভা কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। দেশভাগের সময় তিনি তাঁর স্বামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর পৈতৃকবাড়ি চট্টগ্রামে ফিরে যান। সেখান থেকেই তিনি সমাজকর্মী হিসেবে এবং সংখ্যালঘু বোর্ডের সদস্য হয়ে নির্যাতিত হিন্দুদের জন্য কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে নেলী পূর্ব পাকিস্তানের বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালে নেলী সেনগুপ্ত ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।
১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর নেলী সেনগুপ্তের মৃত্যু হয়।