- ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ধ্বংসের প্রযুক্তি
- ৩২ তলার সেই টুইন টাওয়ারে রয়েছে কয়েকশো ফ্ল্যাট
- টাওয়ারের কোনও অংশ দূরে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যতটুকু এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে টাওয়ার দুটি, তারমধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ধ্বংসস্তুপ।
বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
দিল্লি: সব প্রস্তুতি শেষ। আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের বলে দেওয়া হয়েছে, আগামীকাল রবিবার বেলা ১২’টার আগে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে হবে। গতকাল থেকে দফায় দফায় মাইকে সে কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। আবাসিকদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপেও বারে বারে জানানো হচ্ছে, ১’টার পর সবাইকে বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ঠিক করে দেওয়া ফাঁকা জায়গায় এসে অপেক্ষা করতে হবে। ৫০০ মিটার এলাকা পুরোপুরি খালি রাখা হবে বেলা তিনটে পর্যন্ত। সকাল সাতটা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে ওই এলাকা দিয়ে বিমান চলাচল। রাস্তায় যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে বেলা ১২’টার পর।
এই ভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুণতে বেলা দু’টো ২৮ মিনিটে বেজে উঠবে সাইরেন। তিরিশ সেকেন্ড বাজার পর তিরিশ সেকেন্ডের বিরতি। দু’টো ২৯ মিনিটে সাইরেন বেজে উঠবে দ্বিতীয়বার। তিরিশ সেকেন্ড পর দ্বিতীয় সাইরেন থামার পর ফের তিরিশ সেকেন্ডের বিরতি। তৃতীয়বার সাইরেন বেজে থামার মুখে চোখের পলকে ভেঙে পড়বে দিল্লির অদূরে নয়ডার ৩২ তলার সেই টুইন টাওয়ার। যে দুটিতে রয়েছে কয়েকশো ফ্ল্যাট। মাত্র দশ সেকেন্ডে কংক্রিটের ধুলো ময়লা হয়ে মাটিতে মিশে যাবে অত বড় টাওয়ার দুটি। ভারতে যার নজির নেই।
দেশে এত বড় বাড়ি ভাঙার নজির যেমন নেই, তেমনই ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ধ্বংসের প্রযুক্তি। অত বড় বাড়ি শুধু দশ সেকেন্ডে ধুলোয় মিশে যাবে, তাই-ই নয়, ৫০০ মিটার দূরের আবাসন, ৯০০ মিটার দূরের গ্যাস পাইপলাইনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না, ধরবে না সামান্য চিড়ও, এমনটাই দাবি নয়ডা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ভাঙার কাজে যুক্ত মুম্বই ও দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পনি দুটি। টাওয়ারের কোনও অংশ দূরে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যতটুকু এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে টাওয়ার দুটি, তারমধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ধ্বংসস্তুপ।
টুইন টাওয়ার বললেই মনে পড়ে যায় আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। আমেরিকায় আল কায়দার ভয়াবহ আক্রমণ। বিশ্ব আঁতকে উঠেছিল টিভির পর্দায় সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে। দুটি বিমান ধাক্কা মারল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীকগুলির একটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্টেন্টারের টুইন টাওয়ারে। চোখের পলকে ভেঙে পড়ে সেটি। মারা যান ২৯৯৬ জন, গুরুতর জখম ৬ হাজার জনেরও বেশি।
নয়ডার টুইন টাওয়ার সে তুলনায় কিছুই না। কিন্তু বেআইনি নির্মাণের অসুখ কীভাবে এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তার নজির এই টাওয়ার দুটি। টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তের পিছনে আছে দীর্ঘ আইনি লড়াই। সুপারটেক কোম্পানির তৈরি টুইট টাওয়ার বেআইনিভাবে তৈরি বলে অভিযোগ। এলাহাবাদ হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টও ওই নির্মাণ ভেঙে ফেলার পক্ষে অবিচল থাকে।
জানা গিয়েছে, একশো মিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, কুতুব মিনারের থেকেও উঁচু টাওয়ার দুটি মাটিতে গুঁড়িয়ে দিতে ৩৭০০ কেজি বিশেষ ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিস্ফোরণ ঘটানো হবে রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস ব্যবহার করে। টেলিভিশনের পর্দায় গোটা দেশ এত বড় বাড়ি ভাঙার দৃশ্য লাইভ দেখার সুযোগ পাবে, যা আগে হয়নি। গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ জন্য কারিগরি প্রস্তুতি শুরু করা হয়। সাড়ে তিনশো শ্রমিক-কর্মচারী এবং জনা দশ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেমোলিশন ইঞ্জিনিয়ার ভাঙার প্রস্তুতি সেরেছেন।
বিস্ফোরণে বিকট শব্দ হলেও তা থেকে বায়ু দূষণের তেমন আশঙ্কা নেই। তবে ধ্বসংস্তুপের ধুলো থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সে জন্য জিও টেক্সটাইল চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে টুইন টাওয়ার। ফলে ধুলো উড়বে কম। নয়ডা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ধ্বংসস্তুপ সরানো তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। শহরের বাইরে ছয় বিঘা জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে নিয়ে ফেলা হবে ধ্বংসস্তুপ, যার পরিমান হবে আনুমানিক ৫৫ হাজার টন।
টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার কাজ যৌথভাবে করবে মুম্বইয়ের এডিফিস ইঞ্জিনিয়ারিং ও তাদের দক্ষিণ আফ্রিকার অংশীদার সংস্থা জেট ডেমোলিশন। বিস্ফোরণের পর মিনিট দশের সময় লাগবে বাতাসের ধূলিকণা মাটিতে মিশতে। এই দুটি কোম্পানি যৌথভাবে এর আগে তেলেঙ্গানার সচিবালয় ও কেন্দ্রীয় কারাগার এবং গুজরাটের পুরনো মোতেরা স্টেডিয়ামে অবৈধ আবাসিক কমপ্লেক্স ভাঙার কাজ করেছে।
টুইট টাওয়ারটি ভাঙা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে মামলা চলছিল। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এ বছর মার্চে চূড়ান্ত নির্দেশ জারি করে বলে ৪০ তোলার বহুতলটি ভেঙে ফেলতেই হবে।
এর আগেও বেশ কয়েকবার আদালত ওই টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। এমনকী আদালতের নির্দেশ নিয়ে লুকোচুরি খেলা চললে ডিরেক্টরদের জেলে পাঠানোরও হুঁশিয়ারি দেয় কোর্ট। তারপরও বাড়িটি দীর্ঘদিন ভাঙা হয়নি।
টুইন টাওয়ার নিয়ে এলাকাবাসীর অভিযোগ সেটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে তাদের দিনের পর দিন আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
বাড়িটির মালিক সুপার টেক অথরিটির বক্তব্য ছিল, বাড়ির প্ল্যান নয়ডা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করার পর তারা কাজ শুরু করে। নয়ডা কর্তৃপক্ষ আদালতে জানায়, তারা আইআইটি-রুরকির পরামর্শ নিয়ে ওই প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছিল।
আদালতের বক্তব্য, ভুল যেই করুক, নিয়ম মেনে তৈরি না হয়ে থাকলে বাড়ি ভেঙে ফেলতেই হবে। কারণ, এলাকার অন্য আবাসিকদের সমস্যা হচ্ছে। গোটা দেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় সবচেয়ে বড় বেআইনি বাড়ি ভাঙার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় আয়োজন চাক্ষুষ করার জন্য।