বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোট পদ্ধতি বাতিল করে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিলো সেটিকে আংশিক বাতিল করেছে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
কিন্তু যে অংশটি বাতিল করা হয়েছে তার ফলে দেশের সংবিধানে আবারো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ তৈরি হয়েছে এবং সংবিধানের কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনীর জন্য গণভোটের বিধান পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
“আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর মোট ছয়টি বিধান বাতিল করেছে। ওই সংশোধনীতে ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিলো। বাকীগুলো পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পরবর্তী সংসদ এসে যৌক্তিক মনে করলে রাখবে, অথবা রাখবে না,” আদালতের রায়ের পর ব্রিফিংয়ে বলছিলেন সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
অন্যদিকে এই মামলার বিএনপির পক্ষের আইনজীবীদের একজন দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলছেন, “আদালতের আজকের রায়ের ফলে সংবিধান ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া যেই অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন সেই অবস্থায় ফিরলো”।
তবে আইনজীবীরা বলছেন হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে করা বিধান বাতিল হলেও সংবিধানে এখনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরছে না।
বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছিল, তার ওপর একটি রিভিউ পিটিশন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ওই রায় দিয়েছিলেন।
“সেখানে আবেদনকারীদের পক্ষে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে,” রায়ের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে বলছিলেন পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী শরিফ ভুঁইয়া।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হয়।
এর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ায় দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা তৈরি হয় এবং পরের তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়।
এই সংশোধনীতেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবিধানে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো।
গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৮ই আগস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করেন বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন।
পরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল ও ব্যক্তি এ মামলায় পক্ষভুক্ত হয়।
কোনগুলো বাতিল হলো ও আদালত কী বলেছে
আইনজীবীরা বলছেন পঞ্চদশ সংশোধনীতে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিধান বিলুপ্ত সংক্রান্ত দুটি ধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে আদালত বলেছে এগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে।
পাশাপাশি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে থাকা গণভোটের বিধান বিলুপ্তি করে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা করা হয়েছিলো। এটিকে সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করে বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট।
এর আগে ১৯৯১ সালে হওয়া সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে যেভাবে গণভোটের বিধান সংযুক্ত হয়েছিলো সেভাবেই আবার পুনর্বহাল হলো।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আখ্যা দিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হয়েছিলো। এটিকে অসাংবিধানিক, অসঙ্গতিপূর্ণ ও অস্পষ্ট উল্লেখ করে বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট।
পঞ্চদশ সংশোধনীর ৪৪(২) অনুচ্ছেদও বাতিল করেছে হাইকোর্ট। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোন আদালতে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সকল বা এর যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দিতে পারবেন।
এটিকে বাতিল করে আদালত বলেছে সুপ্রিম কোর্ট একটিই কোর্ট এবং সংবিধানের অভিভাবক। “এর গাডির্য়ানশিপ বা তার ক্ষমতা নিম্ন আদালতকে দেয়ার সুযোগ নেই,” আদালতে উদ্ধৃত করে বলছিলেন রুহুল কুদ্দুস কাজল।
ছবির ক্যাপশান, বিভিন্ন কারণে দেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে
আইনজীবী ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য
রায়ের পর রিট আবেদনকারী বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী ডঃ শরীফ ভুঁইয়া বলেছেন, আদালত রায়ের ফলে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরলেও এটি পুরোপুরি ফিরে আসবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় আবেদনকারীদের পক্ষে গেছে।
“আমরা আশা করছি সেটি হবে। তবে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে। কারণ বর্তমান এই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে গঠিত হয়নি। এটি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার কারণে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে উচ্চ আদালতের মতামতের ভিত্তিতে,” প্রেস ব্রিফিংয়ে বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, আজকের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল হয়নি। যেসব সংশোধন পরিমার্জন ও পরিবর্ধন আনা হয়েছিলো ওই সংশোধনীতে তার কিছু বাতিল হয়েছে আর কিছু সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে আদালত।
আরেকজন আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, “আদালত বলেছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় পরিণত হয়েছে। কারণ এটি ছাড়া নির্বাচন ফ্রি ও ফেয়ার হয়না”।
রিট আবেদনকারী বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “এ রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো। ফিরে আসবে কি-না সেটা নির্ভর করবে রাজনীতিকসহ সবার আচরণের মধ্য দিয়ে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: কেন এতো আলোচনা
আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিতে ও আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে।
এর মাধ্যমেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আনা হয়েছিল তার অধীনে নির্বাচনে ওই বছরের বারই জুন ক্ষমতায় এসেছিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে পর বিএনপি সরকার বিচারপতিদের বয়স পরিবর্তন করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক সংকট চরমে ওঠে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছিলো বিএনপি সমর্থিত বিচারপতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতেই বিচারপতিদের বয়স পরিবর্তন করা হয়েছে।
এ নিয়ে সংঘাত সহিংসতার জেরে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা দু বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয় তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো আওয়ামী লীগ।
সেই আওয়ামী লীগের প্রস্তাবেই ২০১১ সালের ৩০শে জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। এরপর থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছে।
এরপর ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে যেই নির্বাচন হয় সেটি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে প্রায় ভোটারবিহীন সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে।
পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপি ও আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। পরে ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি।
কিন্তু গত পাঁচই অগাস্ট আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে যেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে রিট করেন বদিউল আলম মজুমদার।
গত ১৯শে আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
পরে বিএনপি, জামায়াত ও গণফোরামসহ কয়েকটি দল ও কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হলে তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। এর ওপর বার দিন শুনানির পর আদালত আজ রায়ের দিন ধার্য্য করেছিলেন।
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে’।
পঞ্চদশ সংশোধনীর বিস্তারিত তথ্য
২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার দিন সংসদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ৩৯ জন ও এলডিপির একজন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে যাননি।
তখন সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯১টি।
এই পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে এনেছিলেন ২০১১ সালের জুন মাসে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শুধু তত্ত্বাধায়ক সরকার বাতিলই হয় নি, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয়ও ফিরিয়ে আনা হয়।
রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়।
এই সংশোধনীর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ – এই শব্দ-গুচ্ছ সংবিধানে পুনঃ-স্থাপন করার দাবিতে বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলাম পন্থী দল যুগ্মভাবে হরতালের ডাক দেয়।
এই কর্মসূচিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও তাদের সমর্থন জানায়।
ঢাকাসহ সারাদেশে হরতাল সমর্থকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
সূত্র: বিবিসি