Home বিশেষ প্রতিবেদন পদ্মা সেতু: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হচ্ছে শিল্পবিপ্লব

পদ্মা সেতু: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হচ্ছে শিল্পবিপ্লব

সুমন্ত চক্রবর্ত্তী:খুলনা: স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় শিল্প-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে। দেশের বৃহত্তম এই সেতু চালুর পর  ঢাকার সঙ্গে খুলনার সময় লাগছে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। দূরত্ব কমায় বিনিয়োগে উৎসাহী দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই মোংলা বন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছোট-বড় নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পবিপ্লব শুরু হবে। শিল্পনগরী খুলনা ফিরে পাবে পুরনো ঐতিহ্য। শিল্পায়নের কারণে দেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক রাজধানী হবে খুলনা।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) খুলনা কার্যালয় সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর খুলনা বিভাগে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নতুন গড়ে ওঠা  উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইস মিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডক ইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, নির্মাণ শিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প ইত্যাদি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পবিপ্লব শুরু হবে।

এক সময় শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল খুলনা। মূলত পাটকে কেন্দ্র করে অনেক জুট মিল গড়ে উঠেছিল খুলনায়। কিন্তু কালের আবর্তে একে একে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুলনা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। খুলনা ছেড়ে মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় কাজের খোঁজে গেছে। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু নতুন সম্ভাবনা জাগিয়েছে। সবাই আশা করছেন, পদ্মা সেতুর কারণে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থানের গতি বাড়ার পাশাপাশি আয়ের বৈষম্যও কমে যাবে। আবার খুলনায় ফিরতে শুরু করবে মানুষ।

দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সময় ও দূরত্বকে অন্যতম বাধা মনে করেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়াতে ওই বাধা অনেকাংশে কেটে যাবে। এর মধ্যেই খুলনার রূপসা এলাকায় আইটি পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। মোংলা বন্দর থাকায় এ অঞ্চল দিয়ে আমদানি-রপ্তানিও সহজে করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে একটি বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠার জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার, তা পাওয়া যাবে এ অঞ্চলে। নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী নানা ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। ২০৫ একর জমি নিয়ে এই অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। এই অঞ্চলে ইপিজেড আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে। রেলের কাজও চলছে পুরোদমে। এর সঙ্গে চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ এবং পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল। গ্যাস ও জ্বালানির চাহিদা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত হবে খুলনা। এমন সম্ভাবনার মুহূর্তে খুলনার খানজাহান আলী বিমানবন্দরটিও চালুর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দরের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের ব্যবসায়িক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে মোংলা বন্দরের যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মোংলা বন্দরে আমদানি ও রপ্তানিকৃত মালামাল কম সময়ে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যার ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী হবেন।

পদ্মা সেতু ঘিরে এ অঞ্চলে পর্যটনের বড় একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। আগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন স্পটগুলোতে যোগাযোগের কারণে সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটায় যে হারে পর্যটকরা যেতেন এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সহজে, কম খরচে ও কম সময়ে ওইসব স্পটে পর্যটকরা যেতে পারবেন। ফলে এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও পদ্মা সেতু বড় একটি ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র এখন পদ্মা সেতুর মাধ্যমে নাগালে চলে আসবে। এসব পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।

খুলনার প্রবীণ শিক্ষক ও নাগরিক নেতা অধ্যাপক জাফর ইমাম বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে দেশের দৃশ্যপট। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দূরত্ব কমে যাবে। আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে। সেতু চালু হলে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে, বেকারত্ব কমবে। হবে আর্থ-সামাজিক উন্নতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে আরও বেশিসংখ্যক পর্যটক আসবেন। এতে সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত কর্মজীবীদের আয়ের উৎসও বেড়ে যাবে।

মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে মোংলা বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে আমদানি-রপ্তানিকারকরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মোংলা বন্দরের বিনিয়োগ বহুগুণ বেড়ে যাবে।

খুলনা শিল্প ও বণিক সমিতির (চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেছেন ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, খুলনা বিভাগ ও বরিশাল বিভাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ নতুন কল-কারখানা গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগ থেকেই এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা এ অঞ্চলে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যে জমি কেনা শুরু করেছেন। মোট কথা দেশি বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত হয়ে আছেন। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ, নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ, বাইপাস সড়কসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। খুলনা বিমানবন্দর চালু হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা ও পর্যটন শিল্পে ব্যাপক গতির সৃষ্টি হবে। এছাড়া এ অঞ্চলের চারটি বন্দর বেনাপোল, ভোমরা, মোংলা ও পায়রা আরও গতিশীল হবে। ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের এই বন্দরগুলোর প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হবে।