Home চট্টগ্রাম পলিথিনে নাক-মুখ ডুবিয়ে ড্যান্ডির ঘ্রাণ

পলিথিনে নাক-মুখ ডুবিয়ে ড্যান্ডির ঘ্রাণ

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

চট্টগ্রাম: কম খরচে পথ শিশুদের অন্যতম নেশা ড্যান্ডি। যা হাত বাড়ালেই মিলে। তাছাড়া নেশার মধ্যে অন্যান্য নেশা প্রকাশ্যে সেবন করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে ড্যান্ডি জাতীয় এই নেশা জনসম্মুখে সেবন করা যায়। বিশেষ করে দিন মুজুর, রাস্তার টোকাই, ভবঘুরে, কুলি ইত্যাদি শ্রেণির মানুষেরা এই নেশায় আসক্ত তুলনামূলকভাবে বেশি। ড্যান্ডির এই কালো থাবা ক্রমশ সমাজের নিম্নশ্রেণি হয়ে মধ্যবিত্ত সমাজে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।

ড্যান্ডি নেশার উপকরণটির নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যানড্রাইট আঠা। তবে ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামক আঠালো বস্তুটি (গাম) দিয়ে নেশা করে অসংখ্য পথশিশু-কিশোর। টলুইন সমৃদ্ধ এই অ্যাডহেসিভ মূলত ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া ও প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহূত হয়। এই প্রকার গামের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড হল- ডায়ামন্ডনাল, ফ্রেশ প্রভৃতি।

নগরীর মুরাদপুর ফ্লাইওভার, চট্টগ্রাম রেল স্টেশন, ঝাউতলা, আমবাগান, টাইগারপাস, শেরশাহ, রৌফবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুদের ঘোলাটে পলিথিন সদৃশ্য বস্তুতে মুখ ঢুকিয়ে টানতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্যান্ডি শিশুর শরীরে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এছাড়া মানব শরীরের শ্বসন, পরিপাক, স্নায়ু ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের উপর এই প্রকার নেশার ক্ষতিকারক উপাদানসমূহ নানা বিরূপ প্রভাব ফেলে।

জানা গেছে, কেউ কেউ দিনের বেলা নেশা করলেও বেশিরভাগই নেশা করে রাতে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও নিজের পরিধেয় জামায় ড্যান্ডি গাম লাগিয়ে নেশা করে তারা। ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সের পথশিশুরা পলিথিন ব্যাগে নাক-মুখ ডুবিয়ে ড্যান্ডির ঘ্রাণ নেয়।

মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ড্যান্ডি নেশার বস্তু হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়নি। ফলে নেশাগ্রস্থদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। তাই এটি রোধ করতে সামাজিক সচেতনতা জরুরি।

চিকিৎসাবিদরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রকার নেশায় আক্রান্তদের সমস্যাসমূহ সংক্ষিপ্ত সময়ের ও মৃদু প্রকৃতির হয়। তাই এই সমস্যা মৃদু প্রকৃতির হলে রোগীকে কেবল আশ্বস্ত করাই যথেষ্ট যে- এই সমস্যা গুরুতর কিছু নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই সমস্যাসমূহ হতে রোগী আরোগ্য লাভ করবেন। তবে সমস্যার তীব্র পর্যায়ে, যেমনÑ রোগী সংজ্ঞাহীন হলে, শ্বসনতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া লুপ্ত হলে কিংবা রক্ত বমি হলে আক্রান্ত রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রোগে নিবিড় চিকিৎসার প্রয়োজন। রোগীর মনো-আচরণগত সমস্যা, যেমন- উম্মত্ততা, মারমুখীভাব তীব্র হলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক এন্টিসাইকোটিক ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে। ঘুমের ঔষধ এই ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাত্র ২০-৩০ টাকায় মিলে এই নেশা। অনেক সময় খাবার না খেয়ে ড্যান্ডি কিনে খেলে ক্ষুধার কথাও মনে থাকে না। এই সমস্যা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সমূহ প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, ড্রাগের অবৈধ বিস্তার প্রতিরোধকল্পে বাড়াতে হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এই প্রকার নেশার অবাধ কেনা-বেচা ও পাচারের উপর, প্রয়োজন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, সর্বোপরি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই নেশাসহ অন্যান্য সকল নেশার বিরুদ্ধে সৃষ্টি করতে হবে ব্যাপক গণপ্রতিরোধ এবং এই নেশাসহ অন্যান্য সকল প্রকার নেশা জাতীয় বস্তু কেনা-বেচা ও পাচারের সাথে জড়িতদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে উপযুক্ত শাস্তি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে। এসব জায়গায় ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে এবং পেট্রোল শুঁকে নেশা করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালানো হয়। দেশের সাতটি বিভাগে সাত বছরের ওপরে ১৯ হাজার ৬৬২ জনের ওপর মাদক ব্যবহারের প্রকোপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের ওপর সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. ফারুক আলমের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বছরব্যাপী পরিচালিত এই সমীক্ষার তত্ত্বাবধান করেন।

মাদক সেবনকারীদের ওপর ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের ওপরে বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। এর মধ্যে মারাত্মক অবসাদে আক্রান্ত হয় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, রোগ নিয়ে চিন্তায় থাকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, সব সময় চিন্তাগ্রস্ত থাকে ২ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়ায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ আক্রান্ত থাকে। মাদক সেবনের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া, রাতের বেলা বিছানায় প্রস্রাব করার মতো বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে মাদকাসক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে, কৌতূহল, অসৎ সঙ্গ, মাদকের সহজলভ্যতা, অভিভাবকদের নজরদারির অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ সন্তান প্রতিপালনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।