ড: আহমেদ আবদুল্লাহ
পানাম। পানামকে বলা হয়ে থাকে সােনারগাঁওয়ের ‘সিটি অব ব্যাবিলন। ৩০০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের একটি মডেল টাউন। সােনারগাঁওয়ের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী এই পানাম’।
পানাম শব্দটি ফার্সি। এর অর্থ ‘আশ্রয়’। ইতিহাসে পানামকে উল্লেখ করা হয়েছে পাইনাম’ বলে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সােনারগাঁও উপজেলার একটি গণ্ডগ্রাম আজকের ‘পানাম।
আজ আর ‘পানামকে নগরী বলে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জো নেই। তারপরও ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন মানুষ একে পানাম নগরী বলেই চিহ্নিত করে থাকে। পানাম আজ প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মূলত ৩০০ বছরে বাংলাদেশের একটি নগরচিত্র কমন হতে পারে, তার উদাহরণ ও উপমা পানামের মধ্য দিয়ে দেয়া যেতে পারে। প্রাচীন সােনারগাঁওয়ের সেই জৌলুস, আভিজাত্য হারিয়ে গেলেও পানাম আজো জরাজীর্ণ ভগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
প্রায় অর্ধ কিলােমিটারব্যাপী দাঁড়িয়ে থাকা একতল, দ্বিতল, ক্রিতল ইমারতগুলাে যেন সােনারগাঁওয়ের ইতিহাসের এক নির্মম সাক্ষী। এখানে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্রাকৃতির ইট ও পলেস্তরা পানামের প্রাচীনত্বকে যেন নির্বিঘ্নে প্রকাশ করছে।
আজো যেন ইতিহাসের ধূসর মলাটে বন্দী হয়ে আছে সেই পুরনো রাজধানী, মসলিন হাট, গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রােড, রােডের সূচনা প্রান্তের বন্দর ইজাদি। আজ আছে কেবল পানামের রঙমহলগুলাে। সেই সব রঙমহলে আজ আর নর্তকী, বাঈজীদের নূপুরের শব্দ শােনা যায় না।
তবে কান পেতে শুনলে যেন আপনার কানে বেজে উঠতে পারে অবাধ্য কোনাে নর্তকীর আর্তনাদ কিংবা রাজরাজাদের ঘােড়ার পায়ের ঠুক ঠুক আওয়াজ। পানামের প্রাচীনত্বের সঠিক সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ইতােমধ্যে পানাম নগরী অতিক্রম করে এসেছে কয়েক শ বছর।
পানাম শব্দটির বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় আশ্রয়- এ কথা আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি। মূলত এই নগরীর প্রাচীন দালানকোঠা দেখেও এ কথাই প্রতীয়মান হয়, মধ্যযুগে পানামকে কেন্দ্র করে ধনিক শ্রেণী কিংবা বিত্তশালীদের এক জমজমাট আশ্রয়কেন্দ্র ছিল।
মধ্যযুগে সােনারগাঁও যখন বাংলার রাজধানী ছিল তখন থেকে পানামের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়। সােনারগাঁওয়ের বিখ্যাত ইলিয়াস শাহী আমল থেকে ত্রয়ােদশ, চতুর্দশ শতকেও পানাম ছিল ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নগরী।
পানামকে অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত করেছে নগরীর ভেতরের ও বাইরের কয়েকটি লেক। লেকগুলাের সাথে সংযোগ রয়েছে মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষা নদীর। প্রাচীন এই লেকগুলাে কেবল নগরীর সৌন্দর্য বাড়ানাের জন্যই তৈরি করা হয়নি।
বরং এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক তথা বাণিজ্যিক সুবিধার্দী করায়ত্ত করার লক্ষ্যেই এই লেকগুলাে তৈরি করা হয়েছিল। মূলত এই লেকগুলাের দুই তীর থেমেই পানাম নগরীর নগরসভ্যতার বিন্যাস ঘটেছিল।
পানাম নগরীকে ঘিরে যেসব দিঘি ও পরিখা খনন করা হয়েছিল একমাত্র রাজকীয় ও বিত্তশালী পরিবার ব্যতীত এমন নয়নাভিরাম দিঘি এবং কারুকার্যময় স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ, মন্দির ও ইমরাত নির্মাণ সম্ভব নয়।
-লেখক: জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক