ডঃ আহমেদ আবদুল্লাহ
সুলতানি আমলের কিছু স্থাপত্য একসময় দেখা গেলেও আজ আর তা চোখে পড়ে না। পানাম নগরীর নীলকুঠির সর্দার বাড়ি, ছােট সর্দার বাড়ি, পােদ্দারবাড়ি এসব ইমারতসহ পানাম নগরীর পাশে গােয়ালদীতে আলাউদ্দিন হােসেন শাহের আমলে নির্মিত গােয়ালদী মসজিদ (১৫২২) আমাদের ইতিহাসের অমূল্য সাক্ষী হয়ে বিরাজ করছে।
গােয়ালদী মসজিদের অপূর্ব স্থাপত্যমণ্ডিত কারুকার্য আমাদের লােক ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কেবল গােয়ালদী মসজিদই নয়।
লতাপাতা, প্রাকৃতিক দৃশ্যসংবলিত পেইন্টিং ও অলঙ্করণ পানামের প্রায় সব কটি ইমারতের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পাঞ্জাব থেকে আসা শের শাহের বিখ্যাত গ্রান্ড ট্রাং রােড (১৬০০ খ্রি.) শেষ হয়েছে পানাম নগরীতে এসে। তৎসময়কালে শের শাহ প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে সারা ভারতবর্ষকে অনেকগুলো পরগনায় ভাগ করেছিলেন।
শেরশাহের সময়কালে সরকারই সােনারগাঁওয়ের প্রধান কেন্দ্রভূমি ছিল পানাম। সে সময়কালের ক্রোড়িবাড়ি, “ট্রেজারার হাউস আজো রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অস্তিত্বের কথা আমাদের জানিয়ে দেয়। শের শাহের পর সােনারগাঁওয়ের পরবর্তী ইতিহাস ইসা খাঁ কেন্দ্রিক।
সে সময়ে সােনারগাঁও ছিল ঈসা খার রাজধানী। কারাে মতে পানাম নগরীই ছিল ঈসা খার প্রধান কার্যালয়। ইতিহাসবিদ এফ বিব্রাওলি বার্ট তার বিখ্যাত রােমান্স অব অন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন পানাম ছিল ঈসা খার সামরিক সেনানিবাস। ১৬০৮ সালের দিকে বাংলার নতুন রাজধানী হয় ঢাকা।
এরপর ধীরে ধীরে পানাম তার গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্য হারাতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে পানাম হয়ে ওঠে ভুতুড়ে নগরী। কয়েক শতকের ভাঙচুরের খেলার নীরব সাক্ষী এই পানাম।
২০০৩ সালে সােনারগাঁও ভূমি অফিস এক জরিপ পরিচালনাকালে দেখে কেবল আমিনপুর মৌজাতেই ৪৯ জন অবৈধ দখলদার রয়েছে। অর্থলােলুপ ভূমিদস্যুদের শ্যেনদৃষ্টি থেকে সােনারগাঁওকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলার দাবি বহুকাল ধরেই সুধীমহলে চলে আসছে।
এতে যেমন অতীত ঐতিহ্যের আধার পুরাকীর্তিগুলাে সংরক্ষিত হবে, তেমনি স্থানীয় জনগণের বিকল্প আয়ের উৎস ও জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামকে পরিণত হবে। সরকার ইতােমধ্যে ১৯৬৮ সালের প্রত্নসম্পদ আইনের ১০ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারা (সংশােধিত-১৯৭৬) পুরনাে পানাম শহর ও ছােট সর্দার বাড়িকে তফসিলিভুক্ত প্রত্নসম্পদ বলে ঘােষণা করেছে।
ব্যক্তিস্বার্থের জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, তা কোনােক্রমেই কাম্য নয়। আবার এ-ও সত্য, পর্যটন কেন্দ্র করতে গিয়ে যেন কোনাে আদিবাসী এখান থেকে উচ্ছেদ না হয়।
তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমেই জমি অধিগ্রহণের বন্দোবস্ত করতে হবে। বড় দেরিতে হলেও সােনারগাঁওকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পুরাকীর্তিগুলাের সঠিক আদল বজায় রেখে এর সংস্কার সংরক্ষণের কাজ চলমান রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক নীতিমালা অনুসরণ করা হবে, এটাই কাম্য। নয়তাে পুরাে জাতি যদি আমাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তােলে, সে ক্ষেত্রে আমাদের জবাব দেয়ার কিছুই থাকবে না। কাজেই এখনই এ বিষয়ে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়ােজন।
-লেখক: জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক