তরুণ বয়সে শরীরে তেজ থাকে অনেক বেশি। তাই এই বয়সে অনেক কিছুই আমরা খুব একটা বেশি গুরুত্ব দেই না। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীরে জেঁকে বসে নানা অসুখ।
চোখে ছানি পড়তে শুরু করে, জানা তথ্য মনে করতে অসুবিধা হয়, হাড়গোড় সব যেন বেঁকে বসছে এমন মনে হয়।
এমন কিছু অসুখ আছে যেগুলো প্রবীণদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। তবে আগেভাগেই সে ব্যাপারে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে অসুখগুলো পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও অনেকটাই ভালো থাকা যায়।
শুধুমাত্র প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে ঢাকার সিনিয়র সিটিজেন হসপিটাল। সেখানকার জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিষয়ক চিকিৎসক সামনুন তাহা বাংলাদেশে বয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এমন পাঁচটি অসুখের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন।
নি অস্টিওআর্থরাইটিস
এটি হাঁটুতে ব্যথা তৈরি করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটুর হাড়ে যে তরল পদার্থ রয়েছে সেটি কমে যায়।
তখন পা ভাঁজ করার সময় হাঁটুর দুটি হাড়ে ঘষা লাগে। যার ফলে ব্যথা হতে থাকে। হাঁটুতে শব্দ হয়।
অনেকের হাঁটুর কাছ থেকে পা বেঁকে যেতে যেতে পারে। পুরুষদের চেয়ে নারীদের এই অসুখ বেশি হয় থাকে।
ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স
ডা. তাহা বলেন, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার সমস্যাও বাংলাদেশে অনেক পাওয়া যায় এবং এটিও নারীদের মধ্যে বেশি। মূত্রথলির পেশি দুর্বল হয়ে গেলে এই সমস্যাটি দেখা দেয়।
এই সমস্যায় যারা ভোগেন প্রায়শই তাদের হাঁচি-কাশি দিলে, হাসলে বা ভারী কিছু তোলার সময় মূত্রাশয়ে চাপ পড়ে এবং তখন না চাইলেও কিছুটা মূত্র বের হয়ে যায়।
এতে মূত্রথলিতে প্রদাহ হতে পারে। নারীদের বাচ্চা প্রসবের কারণে পেলভিক মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যায়।
মেনোপজ হলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায়। সে কারণে সমস্যাটি বেশি দেখা দিতে পারে।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ
ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ। এই রোগ হলে কোনো কিছু মনে রাখতে না পারার সমস্যা দেখা দেয়।
কোথায় কী রাখা আছে, কখন কী করতে হবে সেটি মনে করতে সমস্যা তৈরি হয়, কোনো ব্যক্তিকে বা তার নাম ভুলে যাওয়া এমনকি একটু আগেই করা কোন কাজ ভুলে যায় অনেকে।
ডা. সামনুন তাহা বলেন, ডিমেনশিয়ার কোনো চিকিৎসা নেই। বাংলাদেশে আগের চেয়ে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
পার্কিনসন্স ডিজিজ
মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতির কারণে এই রোগ দেখা দেয়। এটি হলে প্রায়ই দেখা যায় হাত, পা, মাথা মৃদু কাঁপছে।
এই রোগে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। হাঁটা চলায় ধীরগতি তৈরি হয়। নারীদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগটি বেশি হয়ে থাকে। এই রোগটি পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়।
মস্তিষ্কে স্ট্রোক
মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলে স্ট্রোক হতে পারে। স্ট্রোক হলে হঠাৎ শরীরের কোনো একটি অংশ, হাত, পা, মুখের একদিক অবশ হয়ে বেঁকে যায়। জিহ্বা অসাড় হয়ে কথা জড়িয়ে যায়, চোখে ঝাপসা লাগতে থাকে। বমি অথবা বমিভাব হতে পারে।
স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে অথবা শারীরিক প্রতিবন্ধীতা দেখা দেয়। বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা দেয় এমন অসুখ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের অসুখের কারণে তাদের স্ট্রোক হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। নারীদের তুলনায় পুরুষদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বয়স ছাড়াও যেসব কারণ
সামনুন তাহা বলেন, বয়স ছাড়াও কিছু অভ্যাস অনেক সময় এসব অসুখের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশে মেঝেতে বসে কাজ করার বেশ প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে নারীরা হাঁটু গেড়ে ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, রান্না করে। এতে হাঁটুতে চাপ সৃষ্টি হয়। আবার দেখা যায় আমাদের দেশে মেয়েরা প্রস্রাব আটকে রাখে। তাদের মূত্রনালির ইনফেকশন হলে সময় মতো চিকিৎসা করা হয় না। এসব কারণে তাদের ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বেশি হয়। আবার তারা লজ্জায় বলতে চায় না তাই এর চিকিৎসাও ঠিক মতো হয় না।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে একটা পর্যায়ে এসে বয়স্ক ব্যক্তিদের অন্যদের সাথে মেলামেশা ও মস্তিষ্কের ব্যাবহার কমে যায়। এ কারণে তাদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
যা করতে পারেন
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর জরাগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়া পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও বিলম্বিত করা যায়, রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডা. সামনুন তাহা পরামর্শ দেন, হাঁটুর ব্যথার ক্ষেত্রে কাজে আসবে নিয়মিত ব্যায়াম, কায়িক পরিশ্রম। হাঁটু গেড়ে খুব বেশি কাজ করা কমাতে হবে।
এছাড়া শরীরে ভিটামিন ডি বৃদ্ধি করার জন্য সূর্যের আলোতে যাওয়া, ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম রয়েছে এমন খাবার খাওয়া।
ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম ঔষধ সেবন করা।
ডা. সামনুন এবিষয়ে বলেন, ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স হলে লজ্জায় বিষয়টি লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। প্রস্রাব এলে তা চেপে না রেখে সময়মতো ত্যাগ করা। এছাড়া মূত্রথলির পেশি শক্ত করা, মূত্রথলির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যায়ামও কাজ লাগে।
নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পরে চিকিৎসকেরা কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন তাতে তাদের হাঁটুর ব্যথা ও ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স সমস্যায় উপকার হয়ে থাকে।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মস্তিষ্কের ব্যবহার বাড়ানো খুব জরুরি। বই পড়া, শব্দ তৈরি করার খেলা, সামাজিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, মানুষের সাথে মেলামেশা বৃদ্ধি করা, মস্তিষ্ক সজীব রাখে এরকম কিছু করলে ডিমেনশিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজে আসে।
পার্কিনসন্স ডিজিজের কোনো নিরাময় নেই তবে কোনো লক্ষণ দেখলে সাথে সাথে ওষুধ শুরু করে এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই রোগে ওষুধ ছাড়াও ফিজিওথেরাপি সাহায্য করে।
সামনুন তাহা বলেন, হার্টের জন্য যা কিছু ভালো তা ব্রেনের জন্য ভালো আমি এভাবে বলবো। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রেশারের ঔষধ ঠিক মতো খাওয়া, রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা, চর্বি জাতীয় খাবার কম খাওয়া এসব করলে বয়সকালের অনেক অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। স্ট্রোকের ক্ষেত্রেওে এটি প্রযোজ্য।
সুষম খাবার খাওয়া ও শরীরে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে জগতের প্রায় সকল অসুখেই উপকার পাওয়া যায়। আর তিরিশের কোঠার শেষের দিক এবং চল্লিশের শুরু একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শরীরের বাড়তি যত্ন নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন ডা. সামনুন তাহা।
সূত্র : বিবিসি