এইচ এম হুমায়ুন কবির, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে :সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা একটি চরের নাম ‘ফাতরার চর’। যদিও বন বিভাগের নামানুসারে এর নাম ‘ফাতরার বন’।
কুয়াকাটা বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষা ফাতরার বনাঞ্চল এখন পর্যটকদের ভ্রমণের অন্যতম পর্যটন স্পট। শীতের শুরুতে সাগর শান্ত থাকায় প্রতিদিন কুয়াকাটায় ভ্রমনে আসা শতশত পর্যটক সাগর পথে ভিড় করছে ফাতরার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরুপ দৃশ্য উপভোগ ছাড়াও পর্যটকরা উপভোগ করতে পারছেন এ বনাঞ্চলের বিভিন্ন প্রাণীর চঞ্চলতা। কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে তালতলী থানার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল এ বনাঞ্চল। মূলত সুন্দরবনেরই একটি অংশ পটুয়াখালীর এই অংশে এসে নাম নিয়েছে ফাতরার চর। বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটাকে চেনে না এমন কম মানুষই আছে। সেই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও খাল পেরিয়ে ট্রলারে করে মাত্র এক ঘণ্টা সময় লাগে এই চরে যেতে। তাই এটিও একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। দিনে দুবার এটি জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। বনে সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, গোলপাতাসহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ দেখা যায়। অজগর, গোখরা, গুই সাপের মতো সরীসৃপেরও দেখা পেতে পারেন ভাগ্য সহায় হলে। এ ছাড়া ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাকে আপনি বিমোহিত হবেন।
দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের বুকে চলার কিছুক্ষণ পরই আপনার চোখে পড়বে সাগরের বুকে জেগে ওঠা ফাতরার চরের বনভূমি। এ যেন সাগরের বুকে ভাসমান কোনো অরণ্য। ট্রলারে চেপে যখনই আপনি ফাতরার চরের খালে ঢুকবেন, তখনই আপনাকে স্বাগত জানাবে দুপাশের ঘন সবুজ অরণ্য। ট্রলারের জেটি পেরিয়ে আপনি চরের ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে শান-বাঁধানো একটি পুকুর ও বন বিভাগ নির্মিত একটি রেস্টহাউস। মূলত চরে অস্থায়ীভাবে বসবাস করা মানুষের মিঠাপানির জন্য করা হয়েছে এই পুকুর। বন বিভাগের কয়েকজন বনরক্ষী ছাড়া এখানে কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করে না। পুকুরপাড় দিয়ে আপনি এবার প্রবেশ করবেন ঘন গহিন অরণ্যে। প্রকৃতির এই নিস্তক্কতার মাঝে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা পাখির ডাক আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। চরের পূর্ব অংশে রয়েছে একটি ছোট সমুদ্র সৈকত, ভাটার সময়ে আপনি নামতে পারেন এই সৈকতটিতে। এখানে যেতে হলে বনের সবুজ অরণ্য আর কয়েকটি ছোট খালের ওপরে তৈরি বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হবে। ঘন সবুজ পেরিয়ে সাগরের বিশালতা মুগ্ধ করবে যেকোনো ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে। তবে দৃষ্টিনন্দন এই চরটিতে এখনো পর্যটকদের জন্য থাকার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আপনি মাত্র দুই ঘণ্টা সুযোগ পাবেন চরটি ঘুরতে। তবে বন বিভাগের কোনো কর্তাব্যক্তির অনুমতি সাপেক্ষে আপনি থাকতে পারেন ওই রেস্টহাউসে। সে ক্ষেত্রে সাক্ষী হওয়ার সুযোগ মিলতে পারে সাগরের বুকে জেগে ওঠা এক গহিন অরণ্যের বিচিত্র সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করার। কেবল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়েই আপনি ঢুকতে পারবেন ফাতরার চরে। ভ্রমণপিয়াসী মানুষের জন্য মাত্র দুই ঘণ্টা হয়তো কয়েক মিনিটের সমান। তবে নাগরিক কোলাহল থেকে ক্ষণিক সময়ের প্রকৃতির এই নৈসর্গিক রূপ আপনাকে রসদ জোগাবে আরো বহুদিন যান্ত্রিকতার ভিড়ে বেঁচে থাকার।
বনবিভাগ সূত্রে জানাযায়, বন বিভাগের খাতায় ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ হলেও স্থানীয় ভাবে এটি ‘ফাতরার বন’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে এই নামকরণ করা হয়। তখনকার হিসাব অনুযায়ী, বরগুনা বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে চোখজুড়ানো এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ১৯২৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। এ বনাঞ্চলে সুন্দরী, কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, তাল, গজারি, বাইন, গোলপাতা, হোগল পাতা, কেওয়া পাতা, হেতাল গাছসহ গুল্ম জাতীয় বৃক্ষ সমারোহ রয়েছে।
এ বনে রয়েছে বানর, কাঠবিড়ালী, বন মোরগ, শিয়াল, বাঘদাস, ভোঁদর, খরগোশ, অজগরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রানী। এছাড়া রয়েছে শতশত বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
এ বনাঞ্চলের তীর ঘেষে ফকিরহাট ও সোনাকাটা চরের খাল, নিশানবাড়িয়ার খাল, বেহুলার খাল, দোনার খাল, ফেচুয়ার খাল, ছোট চরের খাল, বড় চরের খাল গইয়মতলার খালসহ ২০ টি লেক রয়েছে। পর্যটকরা নৌকা ও ট্রলারে করে এ লেকে ঘুরেই বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে ইকোপার্ক তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া বনাঞ্চলের মধ্যে পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট। এ পিকনিক স্পটকে ঘিরে পর্যটকদের ভীড় ক্রমশ বাড়ছে।
শীত মেীসুম থেকে এখানে পর্যটকদের আগমনে উৎসব মুখর ফাতড়ার বনাঞ্চলের পিকনিক স্পটগুলো। বন বিভাগের কর্মীদের সাথে গোটা বন ঘুরেও দেখার সুযোগ রয়েছে। ভাগ্য ভালো হলে চোখে পড়তে পারে বনাঞ্চলের বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু।
ফাতরার বনাঞ্চলে শিক্ষা সফরে ভ্রমনে আসা পর্যটক তুষার, মিজান, মাইনুল জানান, তারা এবারই প্রথম এখানে এসেছেন। এরআগে ৭/৮বার কুয়াকাটা আসলেও এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় তারা ৪০ জন এখানে পিকনিক করতে এসেছেন। এটা অসাধারণ ভ্রমন স্পট। সবকিছুই যেন ছবির মতো সাজানো ও গোছানো।
বনাঞ্চলের সৌন্দর্য বর্ননা করতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হাবিবা বলেন, সামনে বিশাল জলরাশি, পিছনে আকাশের সাথে মিতালী করা বিশাল বিশাল সারি সারি বৃক্ষরাজি। নেই কোন কোলাহল। গাছের উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তাদের কলকাকলী ও প্রকৃতির সৌন্দর্য সবকিছু মিলিয়ে এটা একটা স্বর্গীয় উদ্যান।
ফাতরার বনে রাত্রি যাপনের জন্য একটি রেষ্ট হাউজ ও গোল পাতার ছাউনী দেয়া ছোট ছোট কটেজ রয়েছে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে পর্যটকরা এখানে রাত্রি যাপনও করতে পারবেন। ফাতরার বনাঞ্চল পর্যটকদের ঘুরে দেখানোর জন্য কুয়াকাটায় একাধিক ট্যুরিষ্ট গাইড। তাদের নিজস্ব জলযান থাকায় ফাতরার বনাঞ্চল ঘুরে দেখতে কোন দুর্ভোগ পোহাতে হয়না পর্যটকদের।
পটুয়াখালী বন বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শীত মৌসুমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সরকার কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান নির্মাণ করেছে। এছাড়া ফাতরার বনাঞ্চলে বন্যপ্রানী অভয়ারণ্য গড়ে তুলছে। এ মেীসুমে সাগর শান্ত থাকায় এখন ফাতরার বনাঞ্চলে পর্যটকদের ভীড় বেশি থাকে। ফাতরা বনে জেটি নির্মান করছি এবং এর পাশাপাশি ফুট টেইল ভেঙ্গে মেরামত করছি। একটি উন্নয়ন মুলক প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। তা যদি পাস হয় তাহলে পর্যটকদের আরো ফাতরার বনে ঘুরতে আরো আগ্রহী হবে।