Home অন্যান্য ফিরে দেখা: শঙ্খ ঘোষের ৯০ বছর

ফিরে দেখা: শঙ্খ ঘোষের ৯০ বছর

শিবাশিস মুখোপাধ্যায়

আজ থেকে প্রায় বছর ২৫ আগে আমি আর আমার বন্ধু পিনাকী ঠাকুর শঙ্খ ঘোষের কাছে প্রথম গিয়েছিলাম, আমাদের থেকে কয়েকবছর আগে লিখতে শুরু করা জয়দেব বসু’র সঙ্গে। জয়দেব ছিল শঙ্খবাবুর সাক্ষাৎ ছাত্র, তাই ও বলত স্যার। আমি আর পিনাকীও সেদিন থেকেই ওঁকে বলতে শুরু করেছিলাম স্যার। তাছাড়া, সুনীলদা, উৎপলদা, দিব্যেন্দুদা, সমরেন্দ্রদা’দের যত সহজে দাদা বলতাম আমরা, আমাদের বয়সী কাউকে কখনও ‘শঙ্খদা’ বলতে শুনিনি। তাই ‘শঙ্খবাবু’ বলার চেয়ে ‘স্যার’ বলাটাই আমাদের কাছে সহজ মনে হয়েছিল।

স্যার বলার অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। লেখালিখি শুরু করার সেই প্রথম দিনগুলো থেকেই এতবছর ধরে নানাসময়ে এত অজস্রবার নানা খুঁটিনাটি বিষয় যে জানতে গিয়েছি তাঁর কাছে, আর একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে উনি উত্তর দিয়ে গেছেন আমাদের সেইসব প্রশ্নের- আজ ভেবে দেখলে কিছুটা কুণ্ঠিতই হয়ে পড়ি। কত অমূল্য সময় যে আমাদের জন্য ব্যয় করেছেন তিনি!

বানান থেকে বাক্যগঠন, রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ- বুদ্ধদেব বসু থেকে জগৎ-জীবন-সমাজ- পরিপার্শ্ব, যে কোনও বিষয় নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে, আমাদের কৌতূহল নিরসনের জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়তেন তিনি। হালকা রসিকতায় দূর করে দিতেন এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের দূরত্ব। এমন কি, কখনও কখনও আমাদের নতুন লেখা কবিতাও তাঁকে নিঃসঙ্কোচে দেখিয়েছি আমরা। কখনও ছন্দ, স্পন্দ সংক্রান্ত কোনও নতুন বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন আমাদের, সে লেখার সূত্র ধরেই। কখনও কোনও লেখা ভালো লাগলে বলেছেন সে কথাও। সেইসব মুহূর্তে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতাম আমরা। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ তো এমনই। নিজের চেয়ে অনেক কমবয়েসী কোনও কবির লেখা ভাল লাগলে সে কথা তাকে তিনি জানিয়েছেন অকপটেই।

ওঁর সঙ্গে আমাদের এই সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল অবশ্য ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার কাজের সূত্রে। নব্বই দশক জোড়া আমাদের হৈ-হল্লাকে সঙ্গী করে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন বের করতে শুরু করেছেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা। নানা কাজে ছোটাছুটি করছি আমরাও। সুনীলদা এবার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিলেন আমার উপরে। কৃত্তিবাসের জন্য শঙ্খ ঘোষের একটা সাক্ষাৎকার নিতে হবে আমাকে। আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল! বললাম, ‘আপনি কি ফোন করে একবার বলে দেবেন সাক্ষাৎকার দেবার কথাটা?’
সুনীলদা বললেন, ‘তুমি গিয়ে কৃত্তিবাসের কথাটা বোলো, তাহলেই হবে। শঙ্খ ঘোষ যদি মনে করেন সাক্ষাৎকার দেবেন, তাহলে তুমি বললেই দেবেন। আর শঙ্খ ঘোষ যদি মনে করেন সাক্ষাৎকার দেবেন না, তাহলে আমি বললেও দেবেন না।’

শঙ্খ ঘোষ অবশ্য দিয়েছিলেন সেই সাক্ষাৎকার। কুড়ি-বাইশ পাতার সেই লিখিত সাক্ষাৎকারে ধৈর্য ধরে উত্তর দিয়েছিলেন আমার সব প্রশ্নের। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘কথার পিঠে কথা’ নামের শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার সংকলনে ছাপাও আছে সেই সাক্ষাৎকার। কৃত্তিবাসের নানা অনুষ্ঠানে আসতেন স্যার। কখনও তাঁকে আনতে গেছি বাড়িতে, কখনও তিনি গাড়িতে ফেরার পথে আমাকে নামিয়ে দিয়েছেন উল্টোডাঙায়। কখনও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে গিয়ে তাঁকে দিয়ে দু’এক কথা বলাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, কখনও তিনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছেন দু’চার কথা

কৃত্তিবাসের কাজ করতে করতেই আমি আর পিনাকী ঠাকুর মিলে বের করেছিলাম ‘কাহ্ন’ পত্রিকা। আমাদের তরুণ কবিবন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গে ওঁদের কাছেও লেখা চাইতাম আমরা। সুনীলদা, উৎপলদা, দিব্যেন্দুদা, সমরেন্দ্রদা’দের মতই শঙ্খ ঘোষও ‘কাহ্ন’তে লিখেছেন অজস্র কবিতা। লিখেছেন গদ্যও। ‘কাহ্ন’র জন্য দেওয়া কবিতা স্যার ভরে দিতেন একটা সাদা খামের ভিতর। খামের ওপর উনি নিজের হাতে লিখে দিতেন ‘কাহ্ন’। ওঁর হাতের লেখায় ‘কাহ্ন’ কথাটা নামাঙ্কন হিসেবে পত্রিকার প্রত্যেক পাতার ওপরে ছাপতে শুরু করি আমরা। পরে অবশ্য আরও দু’একটি বিখ্যাত পত্রিকাও ওঁর হাতের লেখাকে পত্রিকার নামাঙ্কন হিসাবে ব্যবহার করেছে দেখেছি।

খামে ভরে লেখা দেওয়ার আর একটা কারণ হল, পত্রিকায় ওঁর দেওয়া লেখাটা যেন ওঁর বাড়িতে বসে কেউ না দেখেন। উনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেন তাতে। আমরা সেটা করতামও না। ওঁর হাত থেকে ‘কাহ্ন’ লেখা খামটা নিয়ে উল্টোডাঙায় একটা চায়ের দোকানে বসে আমি আর পিনাকী প্রথম পড়তাম কবিতাটা। এমনই একবার খামটা খুলে আমরা পড়েছিলাম ‘কাহ্ন’য় লেখা ওঁর সেই অসাধারণ কবিতা ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’, যে কবিতার প্রায় প্রতিটি লাইন প্রবাদে পরিণত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।

তেরটি সংখ্যা পেরিয়ে বন্ধ হয়ে যাবার প্রায় একযুগ পরে ‘কাহ্ন’ পত্রিকার একটা সমগ্র সংকলন বের করার পরিকল্পনা নিয়ে আমি আর পিনাকী একবার হাজির হলাম ওঁর কাছে, সঙ্গে আবদার সেই সংকলনের ভূমিকা লিখে দিতে হবে স্যারকেই। উনি স্মিত হেসে সম্মতি দিলেন তখনই।

কিন্তু কাজটা করতে দেরি হয়ে গেল বেশ কয়েকবছর। তার অবশ্য কারণও ছিল। ব্যক্তিগত পারিবারিক বিপর্যয় সামলে যখন আরেকবার সে কাজে হাত দিতে যাব, তখন আরেক বিপর্যয়। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে চলে গেলেন কবিবন্ধু পিনাকী ঠাকুর। কিন্তু স্যারের কাছে গেলে বা কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হলেই উনি মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই বাকি থাকা কাজটার কথা। কখনও মৃদু রসিকতায় আলতো তাগাদাও দিয়েছেন সে জন্য। ওঁর এই আগ্রহ দেখে শিখেছি, যাঁরা চলে যান তাঁদের কাজটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হল, তাঁদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। সুনীল’দা চলে যাওয়ার পরেও ‘কৃত্তিবাস’ বা ‘বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন’ ইত্যাদি নিয়ে ওঁর সমর্থন ও সহযোগিতাও আমাদের শিখিয়েছে এই কথা।

আজ শঙ্খ ঘোষের নব্বই বছরের জন্মদিন। প্রতিবছর এই দিনটিতে তাঁর বাড়ি গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আসি একবার। কিন্তু এ বছরটা অন্যরকমের। অস্বাভাবিক এই অতিমারির পরিস্থিতিতে বাড়ি গিয়ে ভিড় বাড়িয়ে ঝুঁকি তৈরি করার কোনও মানে হয় না। দূর থেকেই প্রণাম জানাই স্যারকে। আজ সারাদিন স্যারের লেখা পড়েই সময় কাটবে আমার। শঙ্খ ঘোষের রচনা আমার সামনে খোলা থাকবে সারাজীবন।

লেখক ৯০ দশকের অন্যতম প্রধান কবি ও গদ্যকার। আকাশবাণী’তে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ‘কৃত্তিবাস’, ‘দেশ’, ‘বীজল্প’র মতো একাধিক বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। নাটকের জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি অনীতা-সুনীল বসু পুরস্কার, কৃত্তিবাস পুরস্কার, কবিতা আকাদেমির সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্মাননা সহ অজস্র পুরস্কার ও স্বীকৃতি।