Home খেলাধুলা ফুটবল বিশ্বকাপের বিতর্কিত গোল

ফুটবল বিশ্বকাপের বিতর্কিত গোল

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে পৃথিবীর প্রায় যে-কোনো প্রান্তের মানুষের মধ্যেই অগাধ উন্মাদনা লক্ষ করা যায়৷ ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া এই আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ৩২টি দেশের লড়াইকে কেন্দ্র করে অফুরন্ত আবেগ, উত্তেজনা যেন এক উৎসবের চেহারা নেয়। চারবছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই ফুটবল কার্নিভালের জন্য মানুষের অপেক্ষা প্রমাণ করে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা। কিন্তু খেলার মধ্যেকার ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে বিতর্কও দানা বেঁধে উঠতে সময় লাগে না। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস লক্ষ করলেও দেখা যাবে বেশ কিছু গোল নিয়ে তেমনি আলোড়ন তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে এবং গোটা মরশুমজুড়ে এবং তার পরেও দীর্ঘদিন তা নিয়ে শোরগোল, বাগবিতণ্ডা চলেছে।  আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনাকে নিয়ে তেমনই এক বিতর্ক রয়েছে, যা-কিনা আজ প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে উন্নীত। ফুটবল বিশ্বকাপের তেমনই কিছু বিতর্কিত গোল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল এখানে।

১. ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি। ৯০ মিনিটে দুই পক্ষই দুটি করে গোল করে ফলে খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ১০৩ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় জিওফ হার্স্ট পেনাল্টি বক্সের মধ্যে গোলের খুব কাছ থেকে একটি শট মারেন, কিন্তু বলটি উপরের ক্রসবারে লেগে গোললাইনের গায়ে গিয়ে পড়ে এবং তৎক্ষনাৎ জার্মান ডিফেন্ডার জোরালো শট মেরে বল নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। তখন প্রযুক্তি আজকের দিনের মতো উন্নত ছিল না, ফলে গোললাইনের ভিতরে বল ছিল নাকি বাইরে তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। খেলার রেফারি গটফ্রাইড ডিয়েন্সট লাইনসম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে অবশেষে ইংল্যান্ডের পক্ষে গোলের অনুমতি দিয়ে বাঁশি বাজান। যদিও জার্মানদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, বল গোললাইন অতিক্রম করেনি। জিওফ হার্স্ট ১২০ মিনিটের মাথায় আরেকটি গোল করে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করা প্রথম খেলোয়াড় হয়েছিলেন। ৪-২ ব্যবধানে সেই খেলায় ইংল্যান্ড জয়লাভ করলেও হার্স্টের বিতর্কিত গোল টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল সেদিন।

২. ১৯৯০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা এবং পশ্চিম জার্মানি৷ সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার দুই খেলোয়াড় পেদ্রো মনজোন এবং গুস্তাভো দোজাত্তিকে রেফারির নির্দেশে কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। নয়জনের আর্জেন্টিনা অনেক কষ্টে জার্মানিকে প্রতিহত করে রেখেছিল। ৮৫ মিনিটে পশ্চিম জার্মানির রুডি ভলার আর্জেন্টিনার বক্সের মধ্যে একটি থ্রু-বল তাড়া করে দ্রুতবেগে ঢুকে যান। সেসময় আর্জেন্টিনীয় খেলোয়াড় রবার্তো সেনসিনির ট্যাকেলে বক্সের মধ্যে পড়ে যান রুডি। তৎক্ষনাৎ রেফারি আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পেনাল্টির নির্দেশ দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে দেন। যদিও এই সিদ্ধান্ত কতখানি যুক্তিযুক্ত ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আদতেই সেই ট্যাকেলের ফলে পেনাল্টি হওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক জমে ওঠে। রেফারি এডগার্ডো কোডেসালকে তখন ঘিরে ধরে এই নির্দেশের প্রতিবাদ করতে থাকেন আর্জেন্টিনীয় ফুটবলাররা, কিন্তু রেফারি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। শেষপর্যন্ত আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে জার্মানির হয়ে গোল করেন এবং জার্মানি সেবছরের বিশ্বকাপ জিতে নেয়।

৩. ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের একটি স্মরণীয় ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার। কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইতে এই দুই দল সেবার মুখোমুখি হয়েছিল।  বেশ কঠিন লড়াই চলেছিল প্রথমার্ধের খেলায়। দুই কঠিন প্রতিপক্ষ কেউ কাউকেই জমি ছাড়ছিল না একচুল। অবশেষে দ্বিতীয়ার্ধে ৫১ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ডের বক্সের ভিতরে হাওয়ায় ভাসা বলকে হেড মারার ভঙ্গীতে লাফিয়ে আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে অদ্ভুত কায়দায় হাত দিয়ে গোলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি খেলোয়াড় দিয়েগো মারাদোনা। ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটনের মুখোমুখি হয়ে এমনই আশ্চর্য এক কারচুপি করে গোল করলেও রেফারি আলি বিন নাসের কিন্তু বুঝতেই পারেননি বল মারাদোনার হাতে লেগেছে কি লাগেনি। উন্নত প্রযুক্তির অভাবে বাধ্য হয়েই রেফারিকে গোলের বাঁশি বাজাতে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই গোলে বিস্তর বিতর্ক দানা বেঁধে উঠেছিল। মারাদোনার এই গোলের পর তাঁর সে-হাতকে ‘হ্যান্ড অব গড’ বা ঈশ্বরের হাত আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি পরে বলেছিলেন, সেটি আসলে ছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ।

৪. ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বোধহয় সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইংল্যান্ড এবং জার্মানির নকআউট রাউন্ডের খেলা চলছিল ২৭ জুন। ইংল্যান্ডের হয়ে ম্যাথু আপসন গোল করার পর ৩৮ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের মাথায় ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড জার্মানির গোল লক্ষ্য করে একটি জোরালো শট মারেন। বল গিয়ে উপরের ক্রসবারের নীচের দিকে লেগে গোললাইনের কিছুটা ভিতরের দিকে পড়ে এবং ব্যাকস্পিন করে পুনরায় মাঠের মধ্যে চলে আসে। ফুটবলের নিয়ম অনুযায়ী গোললাইনের ভিতরে বল পড়ায় সেটি স্পষ্টতই গোল এবং তা নিয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রেফারি বা লাইনসম্যান কেউই সেই ঘটনাটি লক্ষ্য করেননি কাছ থেকে, ফলত রেফারি নির্বিকারভাবে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই গোলটি পেলে ইংল্যান্ড ২-২ সমতায় ফিরতে পারত। জার্মানিতে এই বিতর্কিত গোলটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রিভেঞ্জ ফর ওয়েম্বলি’ বা ‘ওয়েম্বলি গোল রিলোডেড’।

৫. ২০১০ সালের বিশ্বকাপেরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো। সেটি ছিল রাউন্ড অব ১৬-এর খেলা। ঠিক ২৫ মিনিটের মাথায় কার্লোস টেভেজের হেডে বল জালে জড়ায় এবং আর্জেন্টিনা ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। অথচ গোলের রিপ্লেতে স্পষ্টই দেখা যায় টেভেজ সম্পূর্ণ অফসাইডে দাঁড়িয়ে সেই হেড করেছিলেন। স্টেডিয়ামের স্ক্রিনে সেই রিপ্লে চালানো হলেও সে-গোলটিকে রেফারি কিন্তু বাতিল করেননি। এই সিদ্ধান্তের ফলে সাব-বেঞ্চে মারামারি অশান্তি শুরু হয়েছিল। রেফারিকে মেক্সিকোর পুরো টিম ঘেরাও করেছিল। অবশ্য এতসবের পরেও রেফারির সিদ্ধান্ত বদল হয়নি এবং সেই ম্যাচটি আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জিতে নিয়েছিল।

৬. ২০০৯ সালেরই আরেকটি বিতর্কিত গোলের কথা বলা যাক। সেটি ছিল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের একটি ম্যাচ। আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে যে-দল জিতবে তারাই এগিয়ে যাবে বিশ্বকাপের দিকে এবং পরাজিত দল চলে যাবে বাতিলের খাতায়।  ৯০ মিনিট পর্যন্ত ফলাফল অপরিবর্তিত থাকায় খেলা গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। ১০৩ মিনিটে ফ্রান্স হাফওয়ে লাইনের কাছে একটি ফ্রি-কিক জিতেছিল। ফ্লোরেন্ট মালোদা ফ্রি-কিকের শটটি বক্সের ভিতরে রাখেন। সেখানে ফ্রান্সের থিয়েরি হেনরি ইচ্ছাকৃতভাবে বলটিকে হাতের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এগিয়ে দেন উইলিয়াম গ্যালাসের কাছে। উইলিয়ামের হাতও বল স্পর্শ করে এবং তিনি হেড দিয়ে বল জালে জড়ান। পরে অবশ্য এই গোলে অফসাইডও স্পষ্ট লক্ষিত হয়। এতকিছুর পরেও রেফারি গোলটিকে বৈধ ঘোষণা করে বাঁশি বাজান। ম্যাচ হেরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ সফর থেকে সেবার আয়ারল্যান্ড বাদ পড়ে গিয়েছিল।

কেবল বিতর্কিত গোল নয়, স্পষ্ট গোল বাতিল করে দেওয়ার ফলেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে বারবার। ল্যাম্পপার্ডের গোলের কথা বলা হয়েছে আগেই। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে রেফারির সিদ্ধান্তকে ঘিরেও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। রাউন্ড অব ১৬-এর খেলায় ইকুয়েডরের রেফারি বায়রন মোরেনো ইতালির অবধারিত এক গোলকে বাতিল করে দেয়। সেবছরই কোয়ার্টার ফাইনালে মিশরীয় রেফারি গামাল-আল-গন্দুর দুটি স্পষ্ট স্প্যানিশ গোল বাতিল করে দেন এবং স্পেনের একের পর এক আক্রমণকে অফসাইড বলে ঘোষণা করছিলেন। অবশেষে পেনাল্টির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া ৫-৩ গোলে জয়লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে উক্ত দুই রেফারির বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিং-এর অভিযোগ ওঠে। মোরেনোকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছিল।