গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে দিন মাতৃক্রোড়ে যে শিশু প্রথম চোখ মেলেছিল, পরবর্তী সময়ে সে শিশুর পরিচিতি দেশের গন্ডিরেখা অতিক্রম করে পরিব্যাপ্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। মা-বাবার আদরের ‘খোকা’, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুপ্রিয় ‘মুজিব ভাই’, সমসাময়িকদের প্রিয় ‘শেখ সাহেব’ থেকে মুক্তিকামী বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অর্জন করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং শেষত: কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা-‘জাতির জনক’, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’।
বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে তাঁর নাম একাকার হয়েছে। এ তো শুধু একটি নাম নয়, বাঙালির জাতীয় মুক্তির ইতিহাস। যে জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিবস। দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালিত হয়ে থাকে। জাতির জনকের শুভ জন্মদিনে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে। ইতোমধ্যে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ দেশব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ সগৌরবে পালিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের আলোয় জাতীয় দিগন্ত আজ উদ্ভাসিত।
মনে পড়ছে ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন ছিল। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবন অর্থাৎ পুরাতন গণভবন সুগন্ধা থেকে দুপুরে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে এলেন তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’
উত্তরে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আসা জনসাধারণকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে আবৃত্তি করে বলতেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’
‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের লালিত স্বপ্ন। ’৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্বকণ্ঠে স্লোগান দেন, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৫২ সালে বলেছিলেন, ‘একদিন আমি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হবো।’ আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদিন আমি এই দেশকে স্বাধীন করব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে তুচ্ছ।’ সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে ধাপে ধাপে তাঁর আরাধ্য কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ’৭০-এর নির্বাচনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।
সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা দিতে তিনি একাই রক্ত দেননি সপরিবারে রক্ত দিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।
মনে পড়ে, ’৭১-এর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা; যে ভাষণ আজ ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন। সেদিন তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই ৭ মার্চের ভাষণই ছিল আমাদের প্রেরণার উৎস। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রারম্ভে বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তাঁর এই শেষ বার্তা স্বাধীনতার ঘোষণা হৃদয়ে ধারণ করে হাতিয়ার তুলে নিয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর দেশকে হানাদার মুক্ত করেও আমরা স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে পারিনি। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন মনে হয়েছে আজ আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। এরপর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ১০ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’-এর প্রথম অধিবেশনে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেন। মাত্র ৭ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি সদ্য স্বাধীন দেশের উপযোগী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিদেশ সফরে গিয়ে তাঁর প্রতি বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা স্বচক্ষে দেখেছি। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, সোভিয়েট ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পোদগর্নি, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হীথ, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটোসহ বিশ্বের বরেণ্য নেতারা বিভিন্ন সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রকাশ করেছেন। আলজেরিয়াতে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক আরেক দিকে শোষিত। আমি শোষিত মানুষের পক্ষে।’
সেই বক্তৃতা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জাতিসংঘে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বক্তৃতায় বলেছেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার।’ যখন সোভিয়েট ইউনিয়নে যান তখন দেশটির শীর্ষ ৪ নেতা পোদগর্নি, কোসিগিন, ব্রেজনেভ ও আঁন্দ্রে গ্রোমিকো তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য ক্রেমলিনে সমবেত হন। ব্রেজনেভ বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘সত্যিই আমি ধন্য। আজ আপনার মতো মহান নেতার সান্নিধ্য লাভ করেছি।’ জাপান সফরকালে সম্রাট হিরোহিতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করে জাপানি ভাষায় বলেছিলেন, ‘সত্যিই আপনি ইতিহাসের একজন মহান নেতা।’ তৎকালীন বিশ্বে মার্শাল টিটো অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। কাছে থেকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।’৭৩-এ কমনওয়েলথ সম্মেলনে ৩২টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধান এসেছিলেন। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
আফ্রিকা মহাদেশের নেতৃবৃন্দ কেনিয়ার জুমো কেনিয়াত্তা, জাম্বিয়ার কেনেথ কাউন্ডা, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুইটলাম, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রাজ্জাক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুব গোয়েনসহ বিশ্বের খ্যাতিমান নেতারাসহ অনেকেই কমনওয়েলথ সম্মেলনে এসেছিলেন। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরত। তিনি অন্তরে যা বিশ্বাস করতেন দেশের মানুষকে এবং বিশ্ববাসীকে তা-ই বলতেন। যেখানেই গিয়েছেন মানুষ তাঁকে আপন করে নিয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পৌঁছার সংবাদ শুনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ তৎক্ষণাৎ অবকাশ কেন্দ্র থেকে ফিরে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘সত্যিই আপনি একজন মহান নেতা এবং আমি কখনোই ভাবিনি আপনার সঙ্গে দেখা হবে।’ এই ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
[লেখক : সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি]