Home বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বদলে যাচ্ছে পোশাক খাতের চিত্র

বদলে যাচ্ছে পোশাক খাতের চিত্র

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে পোশাক কারখানাগুলোতে বাড়ছে যন্ত্রের প্রতি নির্ভরতা। তাতে ক্রমেই বদলে যাচ্ছে দেশের পোশাক খাত। মানবসম্পদের বদলে সেখানে বসছে যন্ত্র। উজ্জ্বল আলোর নিচে লাইন ধরে বসানো সারি সারি সেলাই মেশিন। কাজ করছেন শত শত নারীশ্রমিক। বাংলাদেশের যে কোনো গার্মেন্ট কারখানার চিরচেনা দৃশ্য এটি। তবে ভবিষ্যতে এমন চিত্র খুব একটা দেখা যাবে না। ফলে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাভারে ঢাকা ইপিজেডের সফটেক্স সোয়েটার কারখানায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কক্ষে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় দিনরাত সোয়েটার বোনায় ব্যস্ত ১২০টি নিটিং মেশিন। পাশেই কম্পিউটারে সোয়েটারের নকশা ও নির্দেশনা ঠিক করে দিচ্ছেন কিছু কর্মী। ওই নকশা ও নির্দেশনা মেনেই কাজ করে যাচ্ছে যন্ত্রগুলো।
একসময় যেখানে প্রতি পালায় প্রায় ৭০০ শ্রমিক কাজ করতেন কারখানাটির নিটিং বিভাগে, সেখানে এখন কাজ করেন মাত্র ২২ জন। যন্ত্রে তৈরি সোয়েটারগুলো গোছানোই এখন তাদের মূল কাজ। এই কারখানায় এখন জার্মানি ও চীনের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ১৯২টি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে নিটিংয়ের কাজ হচ্ছে। আর একসময় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক যৌথভাবে যা উৎপাদন করত এখন অর্ধেক শ্রমিক দিয়ে আধুনিক মেশিনে তার চেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে।
শুধু সফটেক্স সোয়েটারই নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের বাস্তবতা আর প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে এভাবেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক উৎপাদনের চিত্রটি বদলাতে শুরু করেছে। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মান ভালো হচ্ছে, কমছে কারখানাগুলোর শ্রমিক নির্ভরতা। কমছে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকিও।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ শিল্পে সরাসরি যুক্ত।
সফটেক্স সোয়েটার কারখানার হেড অব অপারেশনস তাহজীব উল গনি শাহজী জানান, এ কারখানায় কাপড় বোনায় আর শ্রমিকের হাত নেই। তিনি বলেন, ‘কম্পিউটারে তৈরি একটি সোয়েটারের নকশা ও পরিমাপ পেনড্রাইভে নিয়ে মেশিনে যুক্ত করে দিলেই হলো। এখন একজন শ্রমিক একাই পাঁচটি মেশিন দেখভাল করতে পারেন। বুননের মূল কাজটি মেশিনই করে। মানুষ শুধু সেগুলো বুঝে নেয়।’
যন্ত্রনির্ভরতার ‘ভালো-মন্দ’ দুটি চিত্রই পাওয়া যায় সফটেক্স সোয়েটারের কর্মকর্তা শাহজীর কথায়। তিনি জানান, তাদের কারখানায় আট বছর আগে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনের ফলে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে অন্তত ৫গুণ। কাজের মানও আগের চেয়ে নিখুঁত হয়েছে। তিনি বলেন, একসময় ছয়শ হাতেচালিত মেশিনে কারখানায় যে কাজ করা হতো, সেখানে এখন মাত্র দুইশ মেশিনে চলছে একই পরিমাণ উৎপাদন। তবে হাতেচালিত নিটিং মেশিনের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপনের ফলে বেকার হয়েছে কিছু শ্রমিক।
প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান জানান, মেশিন চালানোর পাশাপাশি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বোঝেন এমন শ্রমিককে তারা কাজে লাগাচ্ছেন। তবে নিটিং সেকশনের বাইরে উইন্ডিং, লিংকিং, ট্রিমিংসহ অন্যান্য বিভাগ আগের মতোই শ্রমিকের হাতে পরিচালিত হচ্ছে। চার বছর আগে এই কারখানায় তিন হাজার ৬০০ শ্রমিক ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১৪শ শ্রমিক দিয়েই সেই কাজ করে ফেলা যাচ্ছে। বরং কাজের মান, উৎপাদনশীলতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত প্রযুক্তি, রোবট প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে শ্রমিকদের কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা । তাদের মতে, অটোমেশনের ফলে বাংলাদেশে লাখো অদক্ষ শ্রমিকের কর্মহীন হওয়ার আশংকা রয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রও বাড়বে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন ফজলুল হক। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি। পোশাক শিল্প খাতে অটোমেশনের যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, সেটিকে তিনি বিপদ হিসেবে দেখতে রাজি নন। তবে অটোমেশন যে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, সেটা স্বীকার করলেন তিনি, ‘একটা মাঝারি আকারের কারখানার কাটিং সেকশনে দেড়শ-দুইশ লোক লাগত। সেখানে এখন অটোমেটিক কাটিং মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে শ্রমিক লাগে দশ থেকে বারো জন। অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ লোক লাগে। এরকম অটোমেশন কিন্তু চলছেই। আগামী দশ বছরে এই শিল্পে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগে যে ধরনের মেশিন আমদানি করা হতো, তার চেয়ে অনেক ভিন্ন ধরনের মেশিন এখন আনা হচ্ছে। অনেকে রোবটও আনছেন। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরো বাড়বে।