Home কৃষি বরেন্দ্র অঞ্চলে নারীদের রেশম চাষে স্বপ্ন

বরেন্দ্র অঞ্চলে নারীদের রেশম চাষে স্বপ্ন

রাজশাহী: জেলার সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে, মানব সম্পদ উন্নয়নে ও শিল্পের সম্প্রসারণে এবং নারীর ক্ষমতায়নে রেশম শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে দেশের অন্য জেলায় রেশম চাষ হলেও “সিল্কনগরী” রাজশাহী রেশম বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সুপরিচিত। বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় ১০-১২ হাজার নারী রেশম শিল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত। পরিবারে পরিজন সামলে রেশম শিল্পের সম্প্রসারনে নিভৃত পল্লী গ্রামের থেকে শহরের বধুরাই পথ দেখাচ্ছেন রেশম শিল্পের অগ্রসরে ।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ রেশম বীজাগার থেকে রেহেনো বেগম প্রশিক্ষণ নিয়ে পলু পালন শরু করেন। পলু পোকা পালন করে স্বাবলম্বীর চেষ্টা করছেন হতদরিদ্র রেহেনা বেগম নামের এক নারী। তিনি আট বছর থেকে এ পলু পোকার চাষ করছেন। তবে তার জায়গা সল্পতার কারণে নিজ শয়ন ঘরেরর মধ্যে মাচা তৈরী করে পলু পোকা পালন করছেন।

জানা যায় আড়ানী স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের সরকারি জমিতে দুটি ঘর তুলে স্বামী ও ছেলে নিয়ে বসবাস করছে। নিজ শয়ন ঘরের মধ্যে মাচা তৈরী করে পলু পালন করছে। তার স্বামী আবুল হোসেন আড়ানী স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের নামের জমি রেজিষ্ট্রি করে দেন। বিনিময়ে তার স্ত্রীকে একটি আয়া’র চাকুরি দেন। কিছু দিন পর আবুল হোসেনকে ছেড়ে চলে যায় তার প্রথম স্ত্রী। পরে আবুল হোসেন রেহেনা বেগম নামের মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়। কোন পথ খুজে পাচ্ছিলনা। অবশেষে মীরগঞ্জের এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে যায় রেহেনা। সেখানে পলু পোকা পালন দেখে তার আগ্রহ হয়। আগ্রহ শেষে তার আত্মীয়র মাধ্যমে মীরগঞ্জ বীজাগার থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। তবে বাজারে রেশমি সুতার প্রচুর চাহিদা রয়েছে, দামও ভালো। একটি পলু পোকা ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে।নির্দিষ্ট সময় ডিমে অবস্থানের পর পোকার মুখ থেকে লালা বের হয়। এ লালা থেকেই উৎপাদন হয় রেশম গুটি। পরে গুটির ভেতর পোকাগুলো দুই সপ্তাহ অবস্থান করে। এরপর গুটি কেটে সুতা বের করতে হয়। তবে ডিম ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। এ থেকে বছরে তিনবার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। ১০০টি পোকার গুটি থেকে সুতা উৎপাদন হয় ২০ কেজিরও বেশি। যার প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে গ্রীষ্মকালে বাজারদর কিছুটা কম থাকে। তবে রেহেনে বেগম পলু পোকা পালন করে প্রতি বছর গুটি বিক্রি করে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ কেজি। আর এ গুটি বিক্রি করেই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন রেহেনা বেগম।

রেহেনা বেগম জানান, পলু পোকার মূল খাদ্য তুঁত গাছের পাতা। তাই রেশম বোর্ড থেকে তুঁত চাষের জন্য বিনামূল্যে চারা দেন। আমি ভূমিহীন হওয়ার কারণে সরকারি রাস্তার পাশে তুঁত গাছ রোপণ করে পোকার খাদ্য উৎপাদন করে পলু পোকা পালন করছি।

এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁর নিয়ামতপুরের নিভৃত পল্লীতে হচ্ছে রেশমের গুটি চাষ। দেশের কৃষিশিল্পের ঐতিহ্য বহনকারী রেশম চাষে উদ্যোগী হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং দিন বদলের চেষ্টা করছেন রহিমা বেগম । বর্গাদের কাছ থেকে নেয়া জমি ছেড়ে দিয়ে নিজের এক টুকরো জমিতে করেছেন তুত গাছের চাষ। বাড়িতে থাকা পোলু পোকাকে সেই জমির তুত পাতা খাইয়ে চন্দ্র কি’র চাকায় শুরু করেছেন রেশমের গুটি চাষ।

নিয়ামতপুর সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রসুলপুর ইউনিয়নের একটি অবহেলিত গ্রাম সোনাপুরা। সেই গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক সাইদুর রহমান স্ত্রী রহিমা । তিনি গতানুগতিক ধান চাষ ছেড়ে দিয়ে শুরু করেছেন রেশমের গুটি চাষ। আর এ কাজে তাকে উদ্বুদ্ধসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন আড্ডা রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সমন্বয়ক আকিমুদ্দীন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি অন্ধকার ঘরে হাজার হাজার পোলু পোকাকে একটি কাঠের চৌকি ও দড়ির তৈরি খাটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে তুত পাতা খাওয়াচ্ছেন চাষি সাইদুর রহমান। ঘরটিতে নেই আলো-বাতাস সরবরাহের ভাল ব্যবস্থ্য। পোলু পোকার আবাসস্থল চন্দ্র কি’র পরিচর্যা করছেন ও গুটি সংগ্রহ করছেন স্ত্রী রহিমা।

রহিমা বেগম এর স্বামী সাইদুর রহমান জানান, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তিন বিঘা জমি তার। সংসারে নিজের জমিসহ আরো ৪-৫ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করে সাত ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন এবং বিয়ে দিয়েছেন তাদের। অভাবি সংসারে তাদের লেখাপড়া করাতে পরেননি তিনি। ছেলেরা আপন আপন সংসারে ব্যস্ত এখন। বর্তমানে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে তার শরীর। তাই বর্গা জমি নিয়ে ধান চাষ করে ঠিকমতো সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তাই অল্প পরিশ্রমে রেশমের গুটি চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।

তিনি জানান, রেশমের গুটি চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে এর ডিম সংগ্রহ করেছিলেন। সে ডিম থেকে এখন হাজার হাজার পোলু পোকার জন্ম নিয়েছে। তাদের খাওয়ার জন্য এক বিঘা জমিতে তুতগাছ চাষ করেছেন। সেগুলোই খাওয়ানো হয়। পোলু পোকার মাধ্যমে চন্দ্র কি’তে এখন রেশমের গুটি হতে শুরু করেছে তার। আগামীতে তিনি এখান থেকে বছরে চার মণ (১২ কেজিতে ১ মণ) গুটি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদী। যার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তবে তিনি কিছু সমস্যার কথাও জানান। সরকারের কাছে রেশমের গুটি চাষে পোলু ঘরসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ ও পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারি প্রণোদনা দাবি তার। পাশাপাশি রেশন চাষে যথাথ প্রশিক্ষণ।

আড্ডা রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সমন্বয়ক আকিমুদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, গ্রামের ক্ষুদ্র চাষিদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েক বছরেই এ চাষের মাধ্যমে তার কেন্দ্রের কিছু চাষী স্বাবলম্বী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। নিজ বাড়িতে সংসারের কাজের পাশাপাশি রেশম চাষে সামান্য সময় দিয়ে খুব সহজেই ২০-২২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারছেন তারা।