জাফরান পৃথিবীর অন্যতম দামি মসলা যা রেড গোল্ড বা লাল সোনা নামে পরিচিত। জাফরানের ইংরেজি নাম স্যাফ্রন (Saffron) এবং বৈজ্ঞানিক নাম Crocus sativus। এটি irideceae পরিবারের একটি লিলি জাতীয় উদ্ভিদ। জাফরানের আদিস্থান গ্রিস। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ৯০ শতাংশের বেশি জাফরানের জোগান দেয় ইরান। বাকিটার জোগান আসে স্পেন, মরক্কো ও কাশ্মীর থেকে। জাফরান চাষে যন্ত্র নয়, কায়িক শ্রমই ভরসা। চাষের শুরুর পর্যায় থেকে পরবর্তী প্রতিটা ধাপে সবকিছু করতে হয় হাতে হাতে। শেষের দিকে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে লাল গর্ভমুণ্ড বের করে আনার কাজটিও বেশ কষ্টসাধ্য। তাই এর উৎপাদন খরচও বেশি। বিশ্ববাজারে প্রতি গ্রাম জাফরানের দাম চার ডলারের মতো। সে হিসাবে প্রতি কেজি জাফরানের দাম পড়ে তিন লাখ টাকার বেশি।
জাফরান মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলে চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় জাফরান চাষের প্রচলন কখনোই ছিল না। তবে বর্তমানে দেশের আবহাওয়ায় জাফরান চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন ঢাকার শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন।
তিনি আলো-আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জাফরানের ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন এবং সফলভাবে লাল রঙের স্টিগমা (গর্ভমুণ্ড) সংগ্রহ করেছেন যা মূলত জাফরান হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে আবহাওয়াজনিত কারণে ফসল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং বছরে একাধিক বার ফলন ওঠানো যাবে।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, শীতপ্রধান এলাকাগুলোতে যেভাবে উন্মুক্ত পরিসরে জাফরানের চাষ হয়, সেই প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব না। কারণ অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির নিচে করম (কন্দ) দ্রুত পচে যায়। আবার মাটির আর্দ্রতার কারণে গাছের ভালো বৃদ্ধি হলেও ফুল আসে না। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি অ্যারোপনিক্স পদ্ধতিতে (বাতাসের মাধ্যমে গাছের খাদ্য উপাদান সরবরাহ) একটা ছোট আকারের ঘরের মধ্যেই এক হেক্টর সমপরিমাণ জায়গার জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ এই পদ্ধতিতে রোপণ করা গাছের ট্রেগুলো উলম্বভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। জায়গা লাগে কম।
এই গবেষক জানান, গত বছর জাপান থেকে জাফরানের পাঁচ শতাধিক করম আনান তিনি। প্রথমে সেগুলো ফ্রিজে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে রোপণের উপযোগী করা হয়। পরে তা ঘরের মধ্যে প্লাস্টিক ও টিনের তৈরি ট্রেতে রোপণ করা হয়। দেখা যায়, প্রায় সবগুলো গাছেই ফুল এসেছে।
জাফরানের ব্যবহার : জাফরান সারাবিশ্বে রান্নায় ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত। মুঘলদের রসুইঘর থেকে শুরু করে হালের তারকাখচিত হোটেলগুলোতেও জাফরানের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। এ ছাড়া এটা থেকে যেমন সুগন্ধি ও সুন্দর রং তৈরি করা হয়, তেমন ভেষজ ওষুধের উপাদান হিসেবে ও রূপচর্চার ক্ষেত্রেও এর জুড়ি নেই। আর পুরাণ ঢাকার জাফরানি শরবতের যে চাহিদা-জনপ্রিয়তা, তাতে বোঝা যায় এর তৈরি পানীয়ও অনন্য।
জামাল বলেন, ‘সাধারণত জাফরান চাষে বিস্তীর্ণ জায়গার দরকার হয়। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি অ্যারোপনিক্স পদ্ধতিতে (বাতাসের মাধ্যমে গাছের খাদ্য উপাদান সরবরাহ) একটা ছোট আকারের ঘরের মধ্যেই এক হেক্টর সমপরিমাণ জায়গার জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ এই পদ্ধতিতে রোপণ করা গাছের ট্রেগুলো উলম্বভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। জায়গা লাগে কম।’
জাফরানের ফলন : অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের কাছ থেকে জানা যায়, গাঢ় বেগুনি রঙের একেকটি জাফরান ফুল থেকে সাধারণত ৩০ মিলিগ্রাম ওজনের জাফরান পাওয়া যায়। শুকানো অবস্থা যার ওজন দাঁড়ায় সাত মিলিগ্রামে। সে হিসাবে মাত্র এক গ্রাম জাফরান পেতেই অন্তত ১৫০টি ফুলের দরকার হয়। অর্থাৎ এক কেজি সমপরিমাণ জাফরান পেতে দরকার হয় অন্তত দেড় লাখ ফুল। রোপিত করম আকারে বড় ও পুষ্ট হলে প্রথম বছর একটি ও পরবর্তী বছরগুলোতে একেকটি গাছে সাত থেকে আটটি পর্যন্ত ফুল ধরে।
তিনি বলেন, ইরান কিংবা কাশ্মীরে হেক্টর প্রতি জাফরানের ফলন হয় দুই থেকে আড়াই কেজি। কিন্তু মাত্র ১০০ বর্গফুট আয়তনের কোনো গ্রিন হাউস কিংবা নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার ঘরে বছরে সমপরিমাণ জাফরান উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে জাফরানের চাহিদা : বাংলাদেশে প্রতি বছর ঠিক কী পরিমাণ জাফরান আমদানি হয়, কত সংখ্যক মানুষ এর ক্রেতা এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
তবে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনায়েত উল্লাহের কাছে জানা যায়, অধিক দাম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে জাফরানের ক্রেতা অনেক কম। এ কারণে আমদানিও হয় সামান্য। তিনি বলেন, ‘তারপরেও দেশে যে জাফরান আমদানি হয়, তা খুব ভালো মানের না। আমদানি করা মাঝারি মানের জাফরানের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে অনেকে বিক্রি করেন। তাতেও প্রতি কেজি জাফরানের দাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা পড়ে যায়।
চাষের সীমাবদ্ধতা : বাংলাদেশে জাফরান চাষের প্রধান সীমাবদ্ধতা হিসেবে করম সংগ্রহ ও খরচের বিষয়টি সামনে আনেন অধ্যাপক জামাল। তিনি বলেন, এক কেজি জাফরানের জন্য অন্তত দেড় লাখ ফুলের স্টিগমা লাগে। চারা তৈরির জন্য প্রতিটি করমের দাম পড়ে ন্যূনতম ৬০ টাকা করে। সে হিসাবে দেড় লাখ করমের দামই আসে নয় লাখ টাকা। এর সঙ্গে ঘরে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বাতি ও সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য একজন মানুষ দরকার।
তবে খরচ কমিয়ে আনার জন্য একবার করম সংগ্রহ করে পরে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে অনেক চারা তৈরি করা সম্ভব বলে জানান তিনি। বলেন, ‘ঘরে জাফরান চাষের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমিক চাষের মাধ্যমে সারা বছর এর ফলন পাওয়া সম্ভব। উন্মুক্ত পরিসরে বছরে যা একবারই পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জাফরান উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু ওরা এখনও সফল হয়নি। বাংলাদেশে আমরা যতটুকু সফলতা অর্জন করেছি, তাতে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনেও যাওয়া যাবে।’