ড.আহমেদ আবদুল্লাহ
মূলত বৈদিক আর্যদের আগমনের অনেক আগ থেকেই ভারতবর্ষে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। কেবল হরপ্পা বা মহেঞ্জোদারাে নয়, ভারতবর্ষ জুড়েই প্রস্তরযুগীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আর্যরা বিজয়ী হয়েই বিজিত জনগােষ্ঠীর পরিচয় ও সভ্যতাকে অস্বীকার করতে থাকে, এবং অনার্য জনগােষ্ঠীকে (সেমিটিকদের উত্তরপুরুষ) নানা অপমানজনক শব্দে অভিহিত করতে থাকে।
আজ আমরা জানতে পারছি, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই নিষাদ, দ্রাবিড়, কিরাত ইত্যাদি জাতির অস্তিত্ব ছিল। তাদের পরে এসেছে আর্যরা এবং তারও পরে অপরাপর নানা জাতি। এসব অনার্যের একটা নিজস্ব ধর্ম ও কৃষ্টি ছিল। তবে সে ধর্ম ও কৃষ্টি পৌত্তলিকদের পূজা-অর্চনা নয়। কালের বিবর্তনে মানুষ ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে।
এ কারণেই আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানব জাতির হেদায়েতের জন্য জনপদগুলােতে নবী বা রাসূল পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় এই সত্য প্রতিফলিত। আজ দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার ধর্ম, সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলেও এ ধারণা অমূলক নয় যে, ওই সময় কিছুটা বিকৃত ও রূপান্তরিত হলেও একত্ববাদের ধারণা তথা তাওহিদের ধারণা ওই জনগােষ্ঠীর কিয়দংশের ওপর পরিব্যাপ্ত ছিল।
এ কারণেই যখন পরিপূর্ণ তাওহিদের উদাত্ত আহ্বান হজরত মােহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে তখন দলে দলে সবাইকে হারানাে ধর্মের মূল স্রোতে ফিরে আসতে দেখা যায়। সুরজিত দাসগুপ্ত তার ভারতবর্ষ ও ইসলাম গ্রন্থে তাই বলছেন, ঐতিরীয় ব্রাহ্মণে বৈদিক দেবতা অগ্নিকে বলা হয়েছে যে, ইতস্তত ধ্বংসস্তুপগুলােতে একদা যারা বাস করত তারা অগ্নির দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তাদের নাগরিক বাসস্থানগুলা ত্যাগ করে চলে যায়, তারা ভারতবর্ষের গভীরতর অঞ্চলগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে নিজেদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করতে থাকে।
কিন্তু আর পুর’ তারা গড়ে তােলেনি সম্ভবত এই কারণে যে, তাতে ধ্বংসকারী বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। আর সিন্ধু নদের উপত্যকা থেকে তাদের উৎখাত করতে সক্ষম হলেও বিশাল ভারতবর্ষ থেকে তাদের নির্মূল করতে বৈদিক আর্যরা সফল হয়নি। (ভারত বর্ষ ও ইসলাম : সুরজিত দাসগুপ্ত, পৃ. ৯১) এভাবে দেখা যায় যে, আর্যরা অনার্যদের সভ্যতা ধ্বংস করতে সক্ষম হলেও ধর্ম-আশ্রিত সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করতে পারেনি।
এ সময় – আর্য-তাড়িত দ্রাবিড় জনগােষ্ঠী দক্ষিণের বঙ্গ জনপদে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং দলে দলে বসতি গড়ে তােলে। তাদের হাতেই বঙ্গ জনপদের আবাদ হয়। তবে তাদের আগেও সম্ভবত বঙ্গ’ জনপদে জনবসতি ছিল এবং তারা দ্রাবিড় জনগােষ্ঠীর পূর্বপুরুষ হওয়াও বিচিত্র নয়।
-লেখক: জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক