“ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান। সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন”
১৯৩৮ সালে বাটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনটিও ছিল খাসা। তার আগে বলে রাখা ভাল, ভারতে বাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ওই আনুমানিক ১৯২৮ সাল নাগাদ। অনেকে বলেন ১৯৩০ সালের শেষের দিকে। সে কথায় পরে আসা যাবে। বাটা কোম্পানির সেই বিজ্ঞাপনে একটা চমক ছিল। পোস্টারে লেখা ছিল “ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান। সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন।” এই লেখার নিচে পোস্টারে ছিল কিছু পেরেকের মতো ছবি। রাস্তায় খালি পায়ে চলতে গেলে পেরেক ফুটে ধনুষ্টঙ্কার বা টিটেনাস হয়ে যেতে পারে, অতএব জুতো পরাই সুরক্ষিত। আর জুতো মানেই বাটা।
এখানেও একট ব্যাপার আছে। সে সময় জুতোয় পা গলানোর চেয়ে, খালি পায়ে হাঁটতে গাঁ-গঞ্জের মানুষ। শহর বা মফঃস্বলেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একজোড়া জুতো মানে ছিল মহার্ঘ্য। সে নিয়েই বছর কেটে যেত। এখনকার মতো একগাদা ব্র্যান্ড, তার হরেক ডিজাইন ছিল না। মজবুত, টেকসই জুতো মানেই ছিল বাটা। সে সময় ডিজাইনের চাকচিক্যের চেয়ে জুতো কতদিন টিকবে সে চিন্তা বেশি ছিল। ‘ধরণীর মলিন ধূলা’ থেকে পা দু’খানিকে বাঁচাতে সস্তা ও মজবুত আস্তরণের দরকার ছিল। আর সে চাহিদা দায়িত্ব নিয়ে মিটিয়ে চলত বাটা।
জুতো আর বাটার যে এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। আদ্যোপান্ত বিদেশি একটা কোম্পানি কীভাবে গড়পড়তা বাঙালির অন্দরমহলে ঢুকে পড়ল সেটাও ভাববার বিষয়। ধুতি-পাঞ্জাবি হোক বা প্যান্ট-শার্টের বাঙালি, জুতো বলতে সেই বাটাকে ভরসা করত। বাটা কোম্পানি তাই নিছকই একটা ব্র্যান্ড ছিল না নয়, কোথাও একটা বিশ্বাস ও ভরসার সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিল। এখনও যে তার খুব একটা ব্যতিক্রম আছে তেমনটা নয়। স্নিকার্স, ক্যানভাস, বুট, লোফার, ব্যালেরিনা হোক বা হাই-হিল নিউকাট, বাটা তার একচেটিয়া বাজার ধরে রেখেছে। বে, জেনিস, গ্যালারি এপেক্স, লিবার্টি, জেনিস, অরিওনের মতো নামী দামি ব্র্যান্ডের ভিড়েও বাটা তার স্বকীয়তা ধরে রেখেছে বছরের পর বছর।
‘জুতো আবিষ্কার’ করলেন মুচির ছেলে টমাস সাহেব
জুটো আবিষ্কারই বটে। রবি ঠাকুরের কবিতাখানি মিথ্যা হয়নি। মশমশে ঘ্যানঘ্যানে গামবুটের জায়গায় চিকন, পেলব হাল্কা জুতো পায়ে উঠবে, এমনটা আগে ভাবেননি কেউ। টমাস সাহেবই সেই পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মুচির পরিবারের জন্ম। টমাস সাহেব বা টমাস জে বাটার পরিবার জুতো সেলাই করত। সাহেব যখন ছোট, বাবার থেকে দেখে দেখে জুতো সেলাই শিখে নিয়েছিলেন। তাঁর মনে নতুন ভাবনারা ভিড় করত সবসময়। একঘেয়ে ডিজাইনের জায়গায় সবসময়েই আলাদা, অন্যরকম কিছু করতে চাইতেন। এই ইচ্ছা থেকেই বাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠা। অস্ট্রো-হাঙ্গারি সাম্রাজ্যের জলিন শহরে ১৮৯৪ সালে ছোট একটা কারখানা তৈরি করেন টমাস সাহেব। সেদিন ছিল ২৪ অগস্ট। টমাস সাহেব একা ছিলেন না। এই কারখানা তৈরিতে সমান অবদান ছিল তাঁর ভাই এন্তোনিন ও বোন এনার। কারখানার নাম রাখা হয়েছিল ‘টি এন্ড এ বাটা’ ।
কারখানা তো তৈরি হল, লোকবল কই! নিজেই জুতো সেলাই করতেন টমাস সাহেব। উৎপাদন কম, তবে জুতো টেকসই। মনে ধরল অনেকের। ধীরে ধীরে একজন, দুজন করে লোক জুতোর কাজ শিখতে আসতে লাগলেন। জনা দশ কারিগর জোগাড় হওয়ার পরে উৎপাদনও কিছুটা বাড়ল। বিক্রিবাটা ভালই হত। কিন্তু বেশিদিন এ সুখ সইল না। ১৮৯৫ সালেই টমাস সাহেবের ভাই এন্তোনিও চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। বিয়ে হয়ে গেল বোন এনার। টমাস সাহেব একা পড়ে গেলেন। কিন্তু দমে গেলেন না। কীভাবে টি এন্ড এ বাটাকে বাঁচানো যায় সে চিন্তা করতে শুরু করলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর জন্য জুতো বানানোর বরাত পেল বাটা
১৯০৪ সাল। কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মীকে নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলিতে ঘুরতে শুরু করলেন টমাস সাহেব। উদ্দেশ্য আরও নতুন নতুন জুতোর ডিজাইন শেখা। কীভাবে মেশিনে জুতো তৈরি করতে হয় তার কৌশল আয়ত্ত করলেন কম দিনেই। হাতে সেলাই করে এক একটা জুতো বানাতে বড্ড বেশি সময় লাগে। সেখানে মেশিনে কম সময় বেশি উৎপাদন সম্ভব। ডিজাইন করে ছাঁচে ফেললেই জুতো তৈরি। জুতো তৈরির কায়দা শিখে দেশে ফিরলেন সাহেব। তৈরি হল নতুন পথচলা। নতুন ধরনের জুতো বানিয়ে কম দামে বাজারে ছাড়া শুরু করলেন। হুড়হুড়িয়ে কোম্পানির নাম বাড়ল। বিক্রি বাড়ল ঝড়ের গতিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য জুতো বানানোর বরাত পেলেন টমস সাহেব। তাঁর টি অ্যান্ড বাটা কোম্পানির নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের পরে অর্থনীতির অবস্থা বেহাল হল। বাজার মন্দা। লোকসানের মুখে পড়লেন টমাস সাহেব। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। কম দামে লাভের অঙ্ক প্রায় শূন্য রেখেই জুতো বাজারে ছাড়া শুরু করলেন। বিক্রি হল ভালই। টমাস সাহেবের নামও বাড়ল। নিজের কোম্পানির কারিগরদের দুহাতে দান করলেন। তাঁদের খাওয়া পড়ার দায়িত্ব নিলেন। ধন্য ধন্য করল সকলে। টমাস সাহেবকে তাই ‘পূর্ব ইউরোপের হেনরি ফোর্ড’ বলা হত।
১৯৩২ সাল। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল টমাস সাহেবের। বাটা কোম্পানি পিতৃহারা হল। সে সময় কোম্পানির হাল ধরলেন টমাস সাহেবের ভাই এন্তোনিন। কোম্পানি তখন ১৬ হাজারের বেশি কর্মী। ২৭টিরও বেশি কোম্পানি ছড়িয়ে আছে বোহেমিয়া, মোরাভিয়া, স্লোভাকিয়ায়। এন্তোনিনের হাত ধরে বাটা কোম্পানি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ায়। ব্রাজিল, ব্রিটেন, কানাডায় একসময় বাটা কোম্পানির খুব পসার ছিল। আফ্রিকাতেও জনপ্রিয় ছিল বাটার জুতো।
বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে বাটার যোগ কবে থেকে সে কথা আগেই বলেছি। ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ভারতে পা রাখল টমাস সাহেবের বাটা কোম্পানি। অনেকে আবার বলেন ১৯৩১ সাল নাগাদই বাটার পথ চলা শুরু হয় বাংলায়। সে যাই হোক, বাটা তো বাংলায় এল, এবার কারখানা তৈরি হবে কোথায়। হুগলি জেলার কোন্নগরে একটি পরিত্যক্ত কারখানা আর সেটিকে ঘিরে বিঘে খানেক জমিতেই কারখানা তৈরি শুরু হল। বছর পাঁচেকের জন্য জমি লিজ নেওয়া হল। কিন্তু সেখানে জমি কম পরায়, কলকাতা থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে মীরপুর বলে একটি এলাকায় কারখানা সরিয়ে নিয়ে আসা শুরু হল। এই মীরপুর তখন ছিল বজবজ থানার অধীনে। সে সময় শিয়ালদা-বজবজ শাখায় ট্রেন চলাচলও শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই কারখানার পসার বাড়তে দেরি হয়নি। শোনা যায়, এই মীরপুরেরই নাম পরে বদলে বাটানগর রাখা হয়। একটা কোম্পানির নামে আস্ত একটা এলাকার নামই বদলে যায়। এতটাই প্রসিদ্ধি ছিল সে সময় বাটা কোম্পানির।
বাটার কিছু পুরনো বিজ্ঞাপন
-দি ওয়াল