মুঘল বাদশাহের সঙ্গে যখন বিয়ে হল, তখন বাদশাহর বয়স পঁয়ষট্টি বছর, আর মেয়েটির বয়স সতেরো। বাদশাহর অন্য বেগমের ছেলেরাই কেউ কেউ মেয়েটির থেকে বয়সে বড়ো। তার খসম হওয়ার যোগ্য। সতেরো বছরের মেয়েটি লাল কেল্লায় নামল পালকি থেকে, নববধূর বেশে। লোকজনের চাপা গুঞ্জন আর বুড়োর ভীমরতির কথা কানে আসছিল। কিন্তু মেয়েটা দেখছিল লালকেল্লার লাল পাথর। দিন পড়ে এলো। বাদশাহী ব্যাপার!
মির্জা আবু জাফর নাকি অল্পবয়সে পুরুষ সঙ্গীর সান্নিধ্য বেশি পছন্দ করতেন। উভকামিতার লক্ষণ ছিল স্পষ্ট। এইসব দেখে বাদশাহ দ্বিতীয় আকবার শাহ এই শাহজাদা আবু জাফরকে বাতিল করে, বেগম মুমতাজ মহলের (ইনিও দ্বিতীয়) পরামর্শ অনুযায়ী মুমতাজের ছেলে মির্জা জাহাঙ্গীরকে উত্তরাধিকার করবেন বলে স্থির করলেন। কীসের বাদশাহ, আর কোথাকার রাজত্ব! জায়গা বলতে ওই যমুনা নদীর পারে কয়েকটা শহর ঘিরে যে অঞ্চল। জায়গিরদার বললেই ভাল হয়। তার চেয়ে আওয়াধের নবাবের ট্যাঁকের জোর বেশি। তাও, বংশ-মর্যাদা… পারিবারিক সম্মানের ব্যাপার।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল আকবর শাহের সেই সিদ্ধান্ত। স্পষ্ট জানিয়ে দিল – এই শাহজাদা মির্জা শুধু অযোগ্যই নয়, উচ্ছৃঙ্খল এবং মাতালও বটে। সেই শাহজাদারও কীর্তি অনেক… চার্লস সেটন নামে রেসিডেন্সির এক গোরাকে দিলেন গুলি করে! কোম্পানির কর্তা ঘাড় ধরে তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন এলাহাবাদে। পরে আবার ফেরার চেষ্টা করেছিলেন মির্জা জাহাঙ্গীর। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা কমল না, এমনকি বৃদ্ধ আকবার শাহকে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলেন। আবার তাকে তাড়ানো হল। নির্বাসনেই অল্প বয়সে সূর্যাস্ত হল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা শাহজাদা মির্জা জাহাঙ্গীরের। যাঁকে তাঁর মা বাদশাহর গদিতে বসাতে চেয়েছিলেন।
দ্বিতীয় আকবর শাহ চোখ বুজলেন, বাষট্টি বছর বয়সে দিল্লির তখতে বসলেন শাহজাদা মির্জা আবু জাফর। তাজপোশির পর নাম হল বাহাদুর শাহ জাফর। বাদশাহ কবিতা চর্চা ভালোবাসতেন। রীতিমতো কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন উচ্চমানের গীতিকার। উর্দু ও ফারসি ভাষায় ভাল দখল ছিল। গ্রন্থাগার ছিল নিজস্ব। তাঁর আলফাজ দিল্লির কবিতা-প্রেমীদের প্রিয় ছিল। মির্জা গালিব তখন দিল্লি-আগ্রার জনপথে নৈঃশব্দ্য খোঁজেন গভীর রাতে, নেশার ঘোরে মাঝে মাঝে গেয়ে ওঠেন স্বরচিত গজল। বাদশাহর তাঁকে সভায় আগলে রেখে দিলেন, তাঁকে ভূষিত করলেন একের পর এক উপাধিতে – দবির-উল-মুল্ক, নজম-উদ-দৌলা, মির্জা নোশা। সেই সময়ে নবাব, বাদশাহর বংশের না হলে কেউ নামের আগে ‘মির্জা’ বসাত না। বাদশাহ গান শুনতে এবং মঞ্চাভিনয় দেখতেও ভালোবাসতেন।
মুঘল বাদশাহ তখন কোম্পানির মোটা পেনশনে দিন কাটান। কোম্পানির সিভিল সার্জেন্টরা ঠিক করে দেয় প্রশাসনিক কর্তব্য। বাহাদুর শাহ শীলমোহর দেন, না দিলেও চলে। তিন বছর বাদশাহী জীবন কাটিয়ে বাহাদুর শাহ আবার নিকাহ করলেন। একটি অল্পবয়সী মেয়েকে তাঁর খুব মনে ধরে গিয়েছিল। চঞ্চল, লাজুক না, মেয়েলি তেহজীবের আড়ষ্টতা নেই কথাবার্তায়। ইংরাজিতে অনেক সময়ে যাদের বলা হয় ‘Tom Boyish’। হয়তো, একদা পুরুষ-সঙ্গে সচ্ছন্দ ছিলেন বলেই আরো বেশি করে ভালো লেগে গেল ব্যতিক্রমী চরিত্রের ‘অ-মেয়েলি’ মেয়েটিকে। অতি সাধারণ পরিবারের মেয়েটি হল বাদশাহর চতুর্থ বেগম। বিগত যৌবনা অন্যান্য বেগমরা বিরক্তি নিয়ে দেখলেন, একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে বাদশাহের সঙ্গে মহলে প্রবেশ করছে তাঁর নঈ বেগম হয়ে; বেগম জীনাৎ মহল।
অল্প সময়ের মধ্যেই অন্দরমহলের অন্যান্য সহচরীদের এবং প্রজাদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন জীনাৎ মহল। বৃদ্ধ বাদশাহের যুবতী ভার্যা, তাই বাদশাহর ওপরেও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। উনি যা আবদার করতেন, বৃদ্ধ তাই-ই মেনে নিতেন। উনি বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য পালকি নিয়ে রাজপথে এলে, যে পথ দিয়ে যেতেন সেই পথে ডঙ্কা বাজত। লোকমুখে নাম হয়ে গেছিল ‘ডঙ্কা বেগম’। লাল কুঁয়াতে তাঁর প্রাসাদোপম মহলের নামও হয়ে গেল জীনাৎ মহল। ১৮৪৬ সালে বাদশাহী খাজানার অনেকটাই খেয়ে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল প্রাসাদ জীনাৎ মহল। লাল কুঁয়ার সেই জিনাৎ মহল অযত্নে পড়ে আছে আজ। যেমন অযত্নে পড়ে থাকে আমাদের দেশের অনেক কিছুই, অনেকেই।
অন্য বেগমদের হিংসে বাড়ত, কুৎসা রটানো চলত জীনাৎ মহলের নামে। তবে তিনি নিজের পরিকল্পনা এবং কৌশলে অবচিল থাকতেন। জীনাৎ মহল সত্যিই ছিলেন অন্য ধাতুর মানুষ। অন্দরমহলে আবদ্ধ থাকার মতো পর্দানশীন বেগম নন। শুধু সহচরী নয়, সহচররাও থাকত তাঁর সঙ্গে অনুগত এবং বিশ্বস্ত দাসের মতো। যে যা মানে বের করুক, উনি পরোয়া করতেন না।
বাহাদুর শাহ জাফরের বাইশটি ছেলে ছিল, কিন্তু জীনাৎ আর বাহাদুর শাহের একমাত্র সন্তানের নাম মির্জা জওয়াঁ বখত। শাহজাদা দারা বখতের মৃত্যুর পর (পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার কথা, জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ঊনষাট বছর অপেক্ষা করে সাধ অপূর্ণ রেখেই চলে গেলেন) শাহজাদা জওয়াঁ বখতকেই উত্তরাধিকার ঘোষণা করার জন্য জল্পনা শুরু করে দিলেন জীনাৎ মহল। কিন্তু কোম্পানির সাহেবরা না-মঞ্জুর করে দিল, তারা স্পষ্ট জানাল – পরবর্তী উত্তরাধিকার মির্জা ফত-উল-মুল্ক বাহাদুর (ওরফে মির্জা ফাখরু), ওঁকেই আমরা বাদশাহর ওয়ারিস মেনে নেব। জীনাৎ মহল সাময়িক ভাবে দমে গেলেও হাল ছাড়লেন না। অনেক স্বপ্ন ছিল তাঁর একমাত্র পুত্র, জওয়াঁ বখতকে নিয়ে। ১৮৫২ সালে, মাত্র এগারো বছর বয়সে জওয়াঁ বখতের নিকাহ করালেন… খানা-পিনা জশন চলল দশ দিন ধরে!
ব্রিটিশ রেসিডেন্সির কিছু আধিকারিক পারিবারিক ব্যাপারে অতিরিক্ত নাক গলাচ্ছে বলে যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন বেগম জীনাৎ মহল। সেই রাগ থেকেই হত নানারকম কোম্পানি-বিরোধী ষড়যন্ত্র। দিল্লী রেসিডেন্সির স্যার থমাস মেটকেফ যখন ১৮৫৩ সালে দীর্ঘ অসুস্থতার পর মারা গেলেন, অনেকেই সন্দেহ করেছিল, সেটি বিষক্রিয়ার প্রভাব। সন্দেহের তির ছিল বেগম জীনাৎ-এর দিকেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভিজ্ঞ প্রশাসকদের কপালে ভাঁজ বাড়তে শুরু করল। ওঁরা বুঝলেন, লাল কেল্লা নয়, শাসন চলছে লাল কুয়াঁ থেকে। দেখতে দেখতে আরো ক’টা বছর কাটল, ইতিমধ্যে ১৮৫৬-তে বাদশাহী উত্তরাধিকার মির্জা ফাখরুও মারা গেলেন। খুলে গেল নতুন উত্তরাধিকার নিয়ে জল্পনার সম্ভাবনা। কিন্তু আচমকাই এসে পড়ল সিপাহী বিদ্রোহ।
১৮৫৭ একেবারে মোড় ঘুরিয়ে দিল সবার ভাগ্যের। কোম্পানির সাহেবরা জানতেন, অসুস্থ বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর যা-ই ভাবুন বা করুন, বেগম জীনাৎ মহল ইংরেজদের বিপক্ষেই থাকবেন। হলও তাই, উনি লাল কেল্লার দরজা খুলে দিলেন মীরাটের বিদ্রোহী সিপাইদের জন্য। বাদশাহর যুবক শাহজাদারাও এক এক করে ইনকালাব বলে নেমে পড়ল বিদ্রোহের লড়াইয়ে। কিন্তু বেগম সুকৌশলে নিজের ছেলেকে সরিয়ে রাখলেন বিদ্রোহের আগুন থেকে, ওঁর তখনও স্বপ্ন, এইসব মিটে গেলে জওয়াঁ বখতকেই তখতে বসাতে হবে। নিজে সবরকম ভাবে বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে উঠলেন, ছেলেকে রেখে দিলেন আড়ালে। গায়ে আঁচ আসতে দিলেন না।
১২ই মে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ হঠাৎই দরবার ডাকলেন অনেক দিন পর (জীনাৎ-এর কথা মতোই), সিপাইদের প্রতিনিধিরা তাঁকে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার আর্জি জানাল। অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম, চিকের আড়ালে বসে থাকা বেগম জীনাৎ-এর দিকে তাকালেন ইশারার অপেক্ষায়। ১৬ই মে সিপাহীরা প্রায় পঞ্চাশজন ইংরেজকে একদিনে হত্যা করল। দিল্লির ইংরেজ আধিকারিক থেকে ইংরেজ বন্দি – যাকে পেল, তাকেই। হত্যা করা হল সিভিলিয়ান ইংরেজ পরিবারের মানুষজনকেও। শুরু হল লুঠ। লুঠ এবং অরাজকতার বিরোধিতা করলেও প্রকাশ্যে বিদ্রোহকে সমর্থন জানালেন দিল্লির বাদশাহ। কয়েক মাস দিশাহীন খণ্ড-যুদ্ধের পর, দিল্লিকে দ্রুত ঘিরে ফেলল কোম্পানির লাল ফৌজ। উপযুক্ত সেনাপতি এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মত ব্যক্তির অভাব ছিল। অভিজ্ঞতা ছিল না শাহজাদাদের। বাবরের বংশধররা যুদ্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিলেন চারশো বছর পর।
পরাস্ত হল অসম ক্ষমতার বিদ্রোহ, অন্য কোথাও থেকে সামরিক সাহায্যও এল না। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরের বয়স তখন বিরাশি। অসুস্থ শরীর নিয়ে আত্মগোপন করলেন সম্রাট হুমায়ূনের সমাধিসৌধতে। বাদশাহর প্রধান উপদেষ্টা এবং উজির হাকিম আহসানউল্লাহ খাঁ পরামর্শ দিলেন –
‘আগেই নিষেধ করেছিলাম বিদ্রোহের পথে যেতে, গ্রাহ্য করলেন না। অনেক হয়েছে, এবারে আত্মসমর্পণ করুন।’
সেই পরামর্শ মতো বৃদ্ধ আত্মসমর্পণ করলেন, তাতে যদি পরিবার বাঁচে। কিন্তু তা হল না। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আহসানউল্লাহ, ইংরেজদের পক্ষে চলে গিয়ে তাদের হাতে প্রমাণ তুলে দিলেন – বাদশাহ সপরিবার কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। শাহজাদা মির্জা মুঘল এবং মির্জা খিজির সুলতানকে দিল্লি গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করল ইংরেজ মেজর উইলিয়াম হডসন। হত্যা করা হল বাদশাহর পৌত্র আবু বখতকেও। তারপর হুমায়ূনের সমাধিসৌধ থেকে বাদশাহকে বার করে নিয়ে যাওয়া হল লাল কুয়াঁর জীনাৎ মহলে। বন্দী হলেন বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জীনাৎ মহল। যথেষ্ট অপমান এবং বিদ্রূপের শিকার হলেন অসুস্থ এবং অথর্ব বৃদ্ধ বাদশাহ। ইংরেজ ঘোষণা করল, দিল্লির বিদ্রোহ দমন করা গেছে, দিল্লি আমাদের দখলে। ওদিকে তখন লাল কেল্লার সামনে কামনের মুখে বেঁধে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বন্দি বিদ্রোহী-সিপাইকে। সপরিবারে দিল্লি-আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ দেখা প্রজারা। মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের মেহফুজ আশ্রয়ে রাখতে।
৪১ দিন ধরে একাধিক অপরাধের ধারায় বিচার চলল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জীনাৎ মহলের। ২১ জন সাক্ষী, ১৯টি শুনানি। তারপর সাজা ঘোষণা হল। যাঁকে এতদিন বলা হত ‘অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম’, তিনিই হয়ে গেলেন দিল্লি বিদ্রোহের প্রধান অভিযুক্ত। দণ্ডিত হলেন ভারতের শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর। এন্তেকাল হল মুঘল শাসনের।
১৭ বছর বয়সে বেগম হয়ে লাল কেল্লায় পালকি থেকে নামা চঞ্চল মেয়েটি, ৩৪ বছর বয়সে তাঁর বৃদ্ধ অসুস্থ বাদশাহের সঙ্গে নির্বাসনে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে ‘প্রধান অভিযুক্ত’র জেল বা মৃত্যুদণ্ড হল না, কিন্তু নির্বাসন হল একেবারে দেশের বাইরে – রেঙ্গুনে। বাহাদুর শাহ জাফরের অমূল্য গ্রন্থাগারের সব পুঁথি বাজেয়াপ্ত করল কোম্পানি সরকার। বাজেয়াপ্ত করল অনেক বাদশাহী সম্পত্তি, অর্থ; পেনাল্টি অফ রিবেলিয়ন।
বেশ কয়েকটি গোরুর গাড়িতে করে পরিবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার দিল্লিকে চির বিদায় জানিয়ে ভোর চারটের সময়ে (মানে রাতের অন্ধকারেই) নির্বাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন প্রাক্তন-বাদশাহ, সঙ্গে রানির রাজকীয় 9th Lancers এর প্রহরা। ১৭ই অক্টোবর, ১৮৫৮। ভোরের আজান হাহাকারের মতো লাগছিল বৃদ্ধের কানে। বেগম জীনাৎ মহল তাঁর মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিলেন, না দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন জমা ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে – কুইনের লাল সেপাইদের উঁকি দিয়ে দেখার ধৃষ্টতা হয়নি।
এলাহাবাদ অবধি গিয়ে ফিরে এলেন বেগম তাজ মহল সহ অন্যান্য বেগম এবং আরো কিছু সহযাত্রী। কেউ রেঙ্গুন যেতে চাইলেন না বাদশাহর সঙ্গে। সঙ্গে গেলেন শুধু বেগম জীনাৎ মহল আর দুই শাহজাদা – জওয়াঁ বখত এবং শাহ আব্বাস।
জওয়াঁ বখতকে বাদশাহ দেখার খোয়াব অপূর্ণ রয়ে গেল জীনাতের। বাদশাহীও থাকল না। বিদ্রূপের জীবন আর ভূলুন্ঠিত সম্মান নিয়ে দিল্লীতেও থাকতে চাইলেন না ডঙ্কা বেগম। বরং, শত অভিযোগ থাকলেও সেই অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধের নির্ভরযোগ্য সঙ্গিনী হয়ে চলে গেলেন রেঙ্গুন। মাঝে মাঝেই নাকি মুখ ঝামটা দিয়ে বলতেন ‘বুড়ো সারাদিন খক খক করে কেশেই মরে!’
বিদ্রোহের দুই প্রান্তে দুই ভূপতির ভাগ্যের কী অদ্ভুত সমাপতন! ওয়াজিদ আলি শাহ এবং বাহাদুর শাহ। দুজনেই কবি, সংস্কৃতিবান মানুষ, শাসক হিসেবে দুর্বল, অযোগ্য। দুজনেই নির্বাসিত। দুজনেই তাজ হারালেন। দুজনেরই বেগম সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
সালতানাত আর অপমানের স্মৃতি নিয়ে আরো চার বছর বেঁচে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। অন্তিম সময়ে খুব মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন, নিজের দেশের মাটি পেলেন না বলে। বাদশাহর এন্তেকালের পর ‘মুঘল বাদশাহ’ উপাধি বরখাস্ত করল ইংরেজ সরকার (তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ, ভারতে বড়োলাটের আসন পাতা হয়েছে)। বেগম জীনাৎ মহল জীবিত ছিলেন আরো চব্বিশ বছর। রেঙ্গুনেই থাকতেন, দেশে ফেরার ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি। তাঁর শেষ বয়সের একটি আলোকচিত্র আছে, দেখলে মনে হয় – বৃদ্ধার চোখ কত কথা বলে এখনও!
বেগম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ১৮৮৬-তে। বাদশাহর পাশেই সমাধিস্থ হলেন।
মাইকেল মধুসূদনের মতো, বাহাদুর শাহও নিজের এপিটাফ নিজেই লিখে গিয়েছিলেন, এক উর্দু গজল। তার দুটো লাইন এমন – ‘উমর-এ-দরাজ মাংগ্ কে লায়ে থে চার দিন… দো আর্জু মেঁ কট গয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ’।
পাশে জীবনের অনেকগুলো অপূর্ণ ইচ্ছে, অভিযোগ আর আবদার নিয়ে চিরনিদ্রায় রইলেন তাঁর ছোটি বেগম, ভারতের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, বেগম জীনাৎ মহল।