Home Third Lead বিএম ডিপো এখন ধ্বংসস্তূপ

বিএম ডিপো এখন ধ্বংসস্তূপ

ছবি সংগৃহীত

শামসুল ইসলাম, চট্টগ্রাম | ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০

শনিবার রাতে আগুন লাগার পর পেরিয়ে গেছে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময়। ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও। কিন্তু তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও পুরো নেভেনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন। গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, আগের দিনের মতো লেলিহান শিখা নিয়ে না জ্বললেও ধিকিধিকি জ¦লছে কয়েকটি কনটেইনার। আর পুরো ডিপো জুড়ে ছড়ানো ছিটানো আছে বিস্ফোরিত কনটেইনার, শেড আর নানা ধরনের পোড়া জিনিসপত্রের অবশেষ। ২৪ একর জায়গার ডিপোটি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। শনিবার রাতেও ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৪১ জন, নিখোঁজ রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্যসহ আরও বেশ কয়েকজন। দগ্ধ ও আহতদের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২৮ জন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থায় আশঙ্কাজনক। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার দুদিন পরও হয়নি কোনো মামলা। তবে মালিকপক্ষ দাবি করছে, এ ঘটনা পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে।

এদিকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ হাসান এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী। তারা প্রত্যেকেই এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।

গত শনিবার রাত ৯টার দিকে ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে একটি কনটেইনারে আগুন লাগে। খবর পেয়ে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে রাত ১১টার দিকে হঠাৎ রাসায়নিকভর্তি একটি কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এরপর সারা রাতই আগুনের সঙ্গে লড়াই চলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, চট্টগ্রাম শহর থেকে একে একে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট। এর মধ্যেই থেমে থেমে হয় বিস্ফোরণ। আগুনের কাছে যেতেই বেগ পেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের। পানি সংকট ও কনটেইনারে কোন ধরনের দ্রব্য আছে তা না জানায় অথৈ পাথারে পড়েন তারা। ভোররাতের দিকে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে যন্ত্রের সাহায্যে ছিটানো হয় পানি। সকালে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লার ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট যোগ দেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেন রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরাও। পরে যোগ দেন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। রবিবার সন্ধ্যার পর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নেভেনি। গতকাল রাত ১টার পরও সেখানে বিভিন্ন কনটেইনার থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। গতকাল বিএম কনটেইনার টার্মিনালের ম্যানেজার নুরুল আকতার খান জানান, তাদের ডিপোতে ৪ হাজার ৩০০ কনটেইনার ছিল। যার মধ্যে তিন হাজার খালি কনটেইনার। বাকিগুলোর মধ্যে ৮০০ কনটেইনারে রপ্তানি পণ্য এবং ৪৫০টিতে আমদানি পণ্য ছিল। এর মধ্যে ১৭টি পোশাক কারখানার ৮৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৮ ডলারের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তাদের দাবি, প্রায় ৪০০ কনটেইনার আগুনে পুড়ে গেছে।

তবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার পোশাক প্রস্তুতকারকের মোট কত কনটেইনার ও কত মূল্যের পোশাক সেখানে ছিল তার চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যায়নি। গতকাল রাতে বিজিএমইএর সহকারী সচিব আবদুল আজিজ তাদের কাছে আসা প্রতিষ্ঠানের নাম ও পণ্যের মূল্যসংবলিত একটি তালিকা দেন। তালিকায় দেখা যায়, ১৭টি প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার কথা ছিল। এসবের মধ্যে এইচএন্ডএম, এমবিএইচ, টপ গ্রেড ও গ্যাস্টন ব্র্যান্ডের পণ্য ছিল।

গতকাল সকাল ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ডিপোর গেটে অবস্থান নিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে জ¦লন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে স্বজনের খোঁজে ছুটে যাওয়া লোকজন। আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত কর্মীরা ছাড়া কাউকেই ভেতরে দেওয়া হচ্ছে না। গেটে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ডিপোর ভেতরে অনেক কনটেইনার পুড়ে বিবর্ণ হয়ে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক প্লাস্টিকের ড্রাম। বিস্ফোরণে খ–বিখ- হয়ে যাওয়া কনটেইনারের ভাঙা অংশ, লোহার টুকরো, বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে শত শত পোড়া কার্টন। ধসে পড়েছে ডিপোর একপাশে থাকা সেমিপাকা টিনশেড ভবন। কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে অনেক পোড়া কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক। ডিপোর ইয়ার্ডে থাকা একাধিক কনটেইনারের ভেতর থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়ার কু-লী। বাতাসে পোড়া গন্ধ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কনটেইনার কেটে সেখানে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।

সেখানে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য জানান, এখন যে কনটেইনারগুলোতে আগুন জ¦লছে সেগুলোর ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পোশাকপণ্য। সম্ভবত রপ্তানির জন্যই এগুলো রাখা হয়েছিল।

আরও ৪ কনটেইনারে রাসায়নিক শনাক্ত : দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিএম কনটেইনার ডিপোর গেটে আগুনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করেন সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনে ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল। তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে আরও চারটি কনটেইনার শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোর ভেতরে রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। কনটেইনারগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। এছাড়া যেসব কনটেইনারে আগুন ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে আমরা সেগুলো নেভানোর চেষ্টা করছি।’ কবে নাগাদ আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আগুন যাতে আর না ছড়ায় আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

নাশকতার দাবি মালিকপক্ষের : অগ্নিনির্বাপণে মালিকপক্ষের অসহযোগিতার অভিযোগ উঠছিল শুরু থেকেই। আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদেরও দেওয়া হয়নি রাসায়নিক দ্রব্য থাকার তথ্য। রবিবার ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে মালিকপক্ষের কাউকে খুঁজে না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একইদিন এতবড় দুর্ঘটনার পরও মালিকপক্ষের অনুপস্থিতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান। তিন দিনের মাথায় গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান স্মার্ট গ্রুপের পরিচালক আজিজুর রহমান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে আগুনের ঘটনাকে নাশকতা বলে দাবি করে বলেন, ‘ডিপোতে অনেক কনটেইনার ছিল। কিন্তু একটিমাত্র কনটেইনারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ থেকে নাশকতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।’ তিনি বলেন, ‘ডিপোতে কোনো পণ্য প্রবেশ করানো কিংবা বের করার সময় কাস্টমস থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানে বিপজ্জনক কেমিক্যাল থাকলে তা তো কাস্টমসের আগে জানার কথা।’

তিন দিনেও মামলা হয়নি : বিএম ডিপোতে ভয়াবহ কনটেইনার বিস্ফোরণের তিন দিনেও এ নিয়ে কোনো মামলা হয়নি বলে  জানিয়েছেন সীতাকুন্ড থানার ওসি আবুল কালাম।

বিএম ডিপো পরিদর্শনে মন্ত্রীরা : সোনাইছড়িতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ হাসান, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গতকাল দুপুর ২টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থল বিএম ডিপোতে আসেন। তিনি বিএম ডিপো এলাকা পরিদর্শন শেষে ১০ মিনিটের মধ্যে চলে যান। এ সময় সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে যান। এর আধঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসেন নৌপরিবহনমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী। তারা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এ সময় বলেন, ‘এত লোক মারা যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা সবাই ব্যথিত ও মর্মাহত। আর্থিক অনুদান ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিতে আমাদের তিন মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরাও এ ধরনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।’ বিকেল ৫টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন তথ্যমন্ত্রী।

-সৌজন্যে দেশ রূপান্তর