।।এম এ কবীর।।
ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ৫০ পূর্ণ করা এক রাষ্ট্র। দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সংকট আর জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ, এই দেশ কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কিনা সেই আশঙ্কা ছিল বহু বিশেষজ্ঞের। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, সবার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বীরদর্পে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।
১৯৭১। পাকিস্তানি শাসনের বন্দুকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দাঁড়ায় বাঙালি। ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ বলিদান হলো মাত্র ৯ মাসেই। দেড় কোটি লোক উদ্বাস্তু। আশ্রয় শরণার্থী শিবিরে। মানবেতর জীবন ভোগ করল তারা। হাজারো ঘরবাড়ি, স্থাপনা ভস্মীভূত। সেদিনের সেই ত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীন বাংলাদেশ। রচিত হলো সংবিধান। সেই সংবিধানে লেখা হলো, এ দেশের মালিক জনগণ। কয়েকটি দলের শাসন-শোষণে পার হলো ৫০টি বছর।
মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়াই মানবশিশুর স্বাধীনতার প্রথম প্রয়াস। তার পর দোলনা ছেড়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে ঘর-বারান্দা-উঠোন, উঠোন হয়ে রাস্তা ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় যেতে যেতে স্বাধীনতার সাধ আরও বেড়ে যাওয়া। সেই সাধ, স্বাধীনতার স্বাদ কে না পেতে চায়?
দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিলে তিলে রচিত হলো স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আরও সুস্পষ্ট হলো। প্রত্যাশা ছিল সব পশ্চাৎপদ থেকে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে। বে-ইনসাফি দূর হবে। শোষণ থাকবে না। শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না। যৌথতার ভিত্তিতে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিরঙ্কুশ হবে। দূর হবে পরাধীনতার গ্লানি। থাকবে না হতাশা।
স্বাধীনতার পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের তো বটেই, এমনকি ভারতের চেয়েও মাথাপিছু আয়ে আমরা এগিয়ে। ২০২০-২১ সালে অর্থনীতির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আমাদের সম্পদ, আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন যে হারে হয়েছে, আমাদের বৈষম্য, দুর্নীতি, অধিকারহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও বঞ্চনা সে হারে কমেনি; বরং আয় উন্নতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বেড়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা গত ৫০ বছরে অনেক কমে এলেও সব নাগরিকের জীবনে মৌলিক চাহিদা এখনও নিশ্চিত হয়নি।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ-এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি-সিডিপি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাসূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদন্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি ২৫৫৪ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম; যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এই সময়ে পালন হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই লগ্নে বলা যায়, শতভাগ নাগরিকই কি গত ৫০ বছরে সমানভাবে সমান সমান স্বাধীনতা ভোগ করে আসতে পারলেন, আগামী পঞ্চাশ বছরেও তা পারবেন? অনেক নাগরিকের স্বাধীনতা এমন, যেন দেশটাই তাদের। বাকি যারা, তারা দেশে আশ্রিত। কোনোমতে মাথা গুঁঁজে জীবনটা পার করে যাওয়াই তাদের নৈমিত্তিক বাস্তবতা। শহর ও গ্রাম, কেন্দ্র ও বিকেন্দ্রের ব্যবধান স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কতটুকু ঘুচেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসা বাদেও জীবনের আর যা যা অনুষঙ্গ, তাতেও কি বিস্তর ব্যবধান রচিত হয়ে নেই? তা হলে স্বাধীনতার সুফল গ্রামীণ মানুষ কতটুকু পেল আর শহরের নাগরিক কতটুকু পেল? গ্রামের জোতদার মহাজন বা ভূস্বামী ও তার পরিবারের জন্য কতখানি স্বাধীনতা বরাদ্দ আর কতটুকু বরাদ্দ দিনমজুর, ভূমিহীন বর্গাচাষি কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য? স্বাধীনতার কতখানি বরাদ্দ শহরের শিল্পপতি, আমলা, কথিত উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য আর কতটুকু বরাদ্দ বস্তিবাসী, ছিন্নমূল, ভাসমান, পোশাক শ্রমিকদের জন্য? কতটুকু স্বাধীনতা বরাদ্দ পাশের বাসার গৃহকর্মীর জন্য? কতটুকু স্বাধীনতা বরাদ্দ ইটভাটার শ্রমিক, ভ্যান-রিকশাচালক, নগরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর জন্য? কতখানি স্বাধীনতা বরাদ্দ নগরের অভিজাত বলে কথিক এলাকার বাসিন্দাদের জন্য? কতখানি স্বাধীনতা বরাদ্দ সরকারি দলের নেতাকর্মীদের জন্য আর কতটুকু স্বাধীনতা বরাদ্দবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের?
আমাদের সম্পদ, আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন যে হারে হয়েছে, আমাদের বৈষম্য, দুর্নীতি, অধিকারহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও বঞ্চনা সে হারে কমেনি; বরং আয় উন্নতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বেড়েছে
যখন দেশের সব নাগরিকের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে, তখনই দেশটা এগিয়ে যায়, ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন হয়। আমার বন্ধু ভালো থাক, তবে আমার চেয়ে যেন বেতন কম পায়। বন্ধুর ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়–ক আমি চাই, কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে পড়ুক কানাডা, আমেরিকায়। আমার ভাইয়ের বাড়ি হোক আমি চাই, তবে আমার বাড়ির চেয়ে একতলা কম হোক। ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার পাক আমি চাই, কারণ আমি মানবিক। কিন্তু লোকটির চেয়ে আমি যেন একটু বেশি খেতে পারি। প্রেস ক্লাব, শাহবাগে আমিই দাঁড়িয়ে যাব প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে- ‘নারী নির্যাতন বন্ধ কর’, আবার আমিই বাসার কাজের গৃহকর্মীকে কখনই ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে বলব না, তুমিও খাও। দেশের সব লোকের বাসস্থান হোক সেও আমি চাই, কিন্তু আমার একটা বাড়ি হোক কানাডার বেগমপাড়ায়। দেশের মানুষ চিকিৎসা পাক থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, সদর হাসপাতালে, কিন্তু আমার পরিবারের চিকিৎসা হবে বিদেশে! ৫০ বছরের বাংলাদেশে সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে এ নিয়েই। তা হলে কবির ভাষায় প্রশ্ন করা যায়- ‘কতদূর এগোলো মানুষ? কতদূর প্রতিষ্ঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার? কতখানি সম্মানিত হলো ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ নারীর ত্যাগ বিসর্জন, দেড় কোটি শরণার্থীর বিচ্যুত জীবন?’
বঙ্গোপসাগরের কোলে পা দুলাচ্ছে ছোট্ট খুকী, বাংলাদেশ। সুখীজনে যারা, তারা বলবে- দুঃখী মেয়ে বাংলাদেশ। এই দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা। তারা গরিব মানুষ, দুঃখী মানুষ, অভাবগ্রস্ত মানুষ, মলিন পোশাকের মানুষ, ক্ষুধা লাগা মানুষ। তবুও তাদের মুখের হাসিটি খুব সরল। লাউডগার মতো সরল, কুমড়ো ফুলের মতো সরল। গ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে ছেলেমেয়েরা শহরে যাচ্ছে। শহর থেকে আরও বড় শহরে। তার পর বড় দুর্নীতিগ্রস্ত জীবিকায় নিজেকে বাঁচাতে চাচ্ছে। তার নিজেকে বাঁচানোর আড়ালে অনেক মানুষের মুখ ম্রিয়মাণ। মৃত্যু ত্বরান্বিত। সভ্যতার এই এক নিষ্ঠুর চাকা হাজার বছর ধরে, সমাজব্যবস্থার এই এক রূপ। এর মধ্যেও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা নিয়ে মুক্তির লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি। আজ সেই দেশের বয়সপঞ্চাশ, সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি,
ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি