বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
কলকাতা: অতিমারীর দিনে সেই ছায়া সরে গেছে। বদলেছে আরও অনেক কিছু। এখন আর আগের মতো বাড়ি-বাড়ি আনাগোনা নেই। রাস্তায় দেখা হলেও কিছুটা সরে গিয়ে কথা চালাচালি এগোয়। এসবের মধ্যে গ্রাম-শহর দু’জায়গাতেই সৎকারের কানুনও চোখের আড়ালে বদলে যাচ্ছে। কোথাও মেয়েরা এগিয়ে আসছে। আবার কোথাও ভিনদেশে আটকে পড়া ছেলে ভিডিও কলে শেষযাত্রার সাক্ষী থাকছে।
যত দিন গড়াচ্ছে, দেশজুড়ে মৃত্যুমিছিল বেড়েই চলেছে। বাড়ছে সংক্রমণের হার। রোগীভর্তির চাপ নিতে গিয়ে নাজেহাল প্রায় সমস্ত হাসপাতাল। অন্যদিকে রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য শ্মশানের কয়েক হাত মাটিও মিলছে না। এতটাই ভয়াবহ পরিস্থিতি।
সরকারি আদমশুমারি মতে, হিন্দুরা এদেশে সংখ্যাগুরু। পরিজনের মৃত্যুর পর শ্মশানে দাহ করাই তাদের রেওয়াজ। অন্যদিকে ১৫ শতাংশ মুসলিম ধর্মের মানুষেরা রীতিমাফিক মৃতদেহ কবরস্থ করে থাকেন। সাধারণত, হিন্দু, জৈন এবং ইসলাম ধর্মে মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এবং শিখদের তিন দিনের মধ্যে পারলৌকিক ক্রিয়া শেষের বিধান রয়েছে।
কিন্তু এই গোটা সময়-পরিসরটাই কোভিড-কালে বদলে গেছে। এর প্রথম কারণ, অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করতে যত সংখ্যক মানুষ প্রয়োজন, তা এখন পাওয়া সম্ভব নয়। শেষযাত্রায় সকলে সামিলও হতে পারছেন না। হিন্দুদের অনেকে মুখাগ্নির সুযোগটুকুও হারাচ্ছেন। যার জেরে শ্মশান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বচসা, হাতাহাতি এমনকী ছোটখাট সংঘর্ষের ঘটনাও সামনে এসেছে। একদল প্রোটকলের পক্ষে। অন্যদল আবেগের। ফলে যুক্তি বনাম বিশ্বাসের লড়াই ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
অবশ্য এই বিতর্ক আজকের নয়। উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসকেরা এই রীতি উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের চোখে শ্মশানে দাহ করাটা ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ‘আদিম’। কিন্তু জনরোষের কথা চিন্তা করে তাঁরা পিছিয়ে আসেন। দেশের বাইরেও ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ত্রিনিদাদে হিন্দুমতে সৎকারকাজ উঠিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এতে পরিবেশ আদৌ দূষিত হয় না কিংবা এই প্রথা যে বর্বর কিছু নয়, তার জন্য প্রবাসী ভারতীয়রা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালান।
যদিও করোনার সময় পরিস্থিতি পুরোটাই আলাদা। এখন দেশের প্রায় সর্বত্র শ্মশানভূমি খুঁজে পাওয়া দায়। শহরে পার্ক কিংবা হাসপাতালের পার্কিং লটে অস্থায়ী শ্মশান বানানো হচ্ছে। হয়তো কোনও গ্রামে বাড়ির ছেলেরা নেই। কেউ মারা গেছেন। তখনই মুখাগ্নি দিতে এগিয়ে আসছেন মহিলারা। ছোট গঞ্জে হোম আইসোলেশনে থাকা পরিবার হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে শেষযাত্রার সাক্ষী থাকছে।
সৎকার-সংস্কৃতির বদল এখানেই নয়। পুরোহিত পাওয়া যায়নি বলে কোথাও কোথাও সৎকারকর্মীরা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেছেন। গোরস্থানে জায়গা মেলেনি বলে মুসলিমরাও পার্কিং লটের জমি খুঁড়ে প্রিয়জনের দেহ দফন করেছেন।
ঐতিহাসিকেরা বলেন, বিয়ে-অন্নপ্রাশনের মতো রীতিনীতি যত তাড়াতাড়ি বদলায়, অন্ত্যেষ্টির সংস্কৃতি নাকি তত দ্রুত পরিবর্তন হয় না। করোনা এসে হয়তো সেই তত্ত্বকেও নস্যাৎ করতে চলেছে!